মদন লাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভারতের ক্রিকেট কোচিংয়ের জগতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন এই ক্রিকেট কোচিং অ্যাকাডেমিতে একজন ক্রিকেট শিক্ষার্থী সব বিষয়ে সম্যক জ্ঞান নিয়ে যাত্রা শুরু করবে। এর নিবিড় অনুশীলন, অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ এবং শারীরিক ব্যায়ামের রুটিনে প্রতিটি শিক্ষার্থী পেশাদার ক্রিকেটের কঠিন দুনিয়ার জন্য জোর প্রস্তুতি নেয়। মদন লালের অধীনে কোচেরা এখানে ভবিষ্যতের মহাতারকাদের মধ্যে সযত্নে স্বপ্নের বীজ বুনে দেন।
Madan Lal Cricket Academy এর প্রেক্ষাপট
মদন লাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠার পেছনের কারিগর হলেন ভারতীয় সাবেক ক্রিকেটার মদনলাল। মদন লাল উধাও শর্মা ১৯৮২ সালের ভারতীয় বীরদের বিশ্বকাপজয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন। তিনি ভারতের হয়ে ১৯৮৫ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশীপও জেতেন। পাঞ্জাবি এই ক্রিকেটার ভারতীয় জাতীয় দলের হয়ে ৩৯টি টেস্ট ও ৬৭টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন। ক্যারিয়ার শেষে মদন লাল একজন কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ে কোচিং করার পর তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পান। তাঁর অধীনেই ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে অংশ নেয় আমিরাতের দলটি। ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মদন লাল ভারতের জাতীয় দলের কোচের ভূমিকা পালন করেন।
এরপর ২০০০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ভারতের নির্বাচক কমিটির সদস্যপদ পান মদন লাল। ২০০৭ সালে বিদ্রোহী ক্রিকেট লীগ আইসিএলে দিল্লী জায়ান্ট দলের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন মদন লাল। এরপর তিনি নিজের একাডেমি স্থাপনা করেন দিল্লীর সিরি ফোর্ট স্পোর্টস কমপ্লেক্সে। শুরুতে মাত্র দু’জন কোচ দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে মদন লাল নিজের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে নেন।
Madan Lal Cricket Academy এর লক্ষ্য
মদন লাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমির লক্ষ্য হচ্ছে তরুণ ক্রিকেটারদেরকে বিকশিত করে গড়ে তোলা। তাদের প্রতিভা অনুযায়ী টেকনিকের উন্নতি, শারীরিক ফিটনেস বৃদ্ধি ও মানসিক শক্তি দৃঢ় করার ক্ষেত্রে সাহায্য করা হয়। তাদেরকে সঠিক পরিবেশে নিজেদেরকে মেলে ধরবার সুযোগ দেয়া হয় সংখ্যার চেয়ে এখানে মানের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। প্রতি ব্যাচে মাত্র ষাটজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থী যাতে প্রশিক্ষকদের সর্বোচ্চ মনোযোগ পায় সেটি নিশ্চিত করার জন্য মদন লাল একাডেমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
Madan Lal Cricket Academy এর সুবিধাসমূহ
এই একাডেমিতে নয়াদিল্লীর সিরি স্পোর্টস কমপ্লেক্সে অবস্থিত। এখানে সব ধরণের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থীদেরকে সর্বোচ্চ মানের কোচিং দেয়ার পাশাপাশি তাদেরকে অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান করা হয়। দিল্লীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই ক্রিকেট অ্যাকাডেমিটি ক্রমেই দিল্লীবাসীর মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে নিচ্ছে। বর্তমানে এই অ্যাকাডেমিতে সুযোগ পাওয়ার শিক্ষার্থীরা মোটামুটি ভর্তিযুদ্ধের আমেজ নিয়ে লড়াই করে।
মাঠ এবং পিচ
এখানে চারটি টার্ফের মাঠ ব্যবহার করা হয়। এর ফলে আদর্শ খেলার কন্ডিশন তৈরি করা সম্ভব হয়। প্রতিটি পিচেই আন্তর্জাতিক মানের রোলিং ও ঘাসের ব্যবহার করা হয়। ম্যাচ কন্ডিশনের স্বাদ দেয়ার জন্য এই পিচগুলোকে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া শক্ত পিচে শিক্ষার্থীদেরকে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য তিনটি সিমেন্ট পিচের ব্যবস্থা রয়েছে। এটি ক্রিকেট শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একজন আদর্শ ক্রিকেটের পরিচয় হলো সে সব ধরণের পিচ ও কন্ডিশনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে। এখানে একজন শিক্ষার্থীকে সেই সুযোগটাই করে দেয়া হয়। নানান ধরণের কন্ডিশন ও পিচের ব্যবহার তার সামগ্রিক ক্রিকেটীয় বোধকে তীক্ষ্ণতর করে তোলে। অনেক সময়ে দেখা যায় ক্রিকেটারেরা নিজেদের পরিচিত কন্ডিশন ও পিচ ছাড়া বিদেশের মাটিতে হিমশিম খাচ্ছে। এই সমস্যা নিরসনে একাডেমিতে সব ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।
কোচিং স্টাফ
এখানে প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রখ্যাত ভারতীয় ক্রিকেটার মদন লাল। দেশ-বিদেশে কোচিং অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এই কোচ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁর জ্ঞান ছড়িয়ে দেন। তাঁর উপস্থিতি শিক্ষার্থীদেরকে অনুপ্রাণিতও করে বটে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোচিং করানো খুব বেশি কোচ অ্যাকাডেমি পরিচালনার দায়িত্বে নেই। তাই এটি স্থানীয় শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়তি পাওয়া। মদন লাল ছাড়াও এখানে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আরো অনেক কোচ আছেন। সাবেক ভারতীয় পেসার ভেংকটেশ প্রসাদ, স্পিনার মহিন্দর সিং ও ব্যাটসম্যান সঞ্জীব শর্মা এখানে কোচিং করান। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ফিটনেস ট্রেনার আছে এখানে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং ও উইকেটকিপিং – প্রতিটি ক্রিকেটীয় স্কিলের জন্য আলাদা করে কোচ নিয়োগ করা হয়েছে।
Madan Lal Cricket Academy এর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি
মদন লাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে প্রতিটি শিক্ষার্থীদেরকে কাঠামোবদ্ধ শিক্ষা দেয়া হয়। একটি নির্দিষ্ট শিক্ষানীতিকে অনুসরণ করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এখানে টেকনিক্যাল ড্রিল থাকে। শারীরিক কন্ডিশনাল অনুশীলনের আয়োজন করা হয়। ম্যাচের মতন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর সবশেষে ভিডিও অ্যানালাইসিসের আয়োজন করা হয়। বর্তমান সময়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে এই পদ্ধতিটি বহুল প্রচলিত রয়েছে। ভিডিও অ্যানালাইসিস মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষার্থীদের ম্যাচের সময়ে ভুল বের করে সেটি শোধরানোর ব্যবস্থা করা যায়। এর ফলে কোচেরা তাদেরকে সঠিক দিকে নির্দেশনা দেয়ার সুযোগ পান। এখানে শিক্ষার্থীদের খাদ্যাভাসের উপরেও বিশেষ নজর রাখা হয়।
Madan Lal Cricket Academy এর বিশেষ প্রোগ্রাম
একাডেমিতে বিশেষ প্রোগ্রামের ব্যবস্থাও রয়েছে। শিক্ষার্থীরা মদন লালের কাছ থেকে ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ পাবেন বিশেষ প্রোগ্রামে। তাঁর অভিজ্ঞতা ও দর্শনের সংস্পর্শে একজন তরুণ ক্রিকেটারের খেলা সম্পর্কে দৃষ্টিভংগি আমূল পালটে যেতে পারে। নবাগতদেরকে খেলার সাথে পরিচয় করে দেবার জন্য এই ক্রিকেট অ্যাকাডেমি গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পের আয়োজন করে। এর ফলে প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া ছেলেরা নিজেদের দক্ষতাকে ঝালিয়ে নেয়ার সুযোগ পায়। এছাড়া বয়সভিত্তিক দলের ক্যাম্পের মাধ্যমে ছেলেরা নিজেদেরকে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের জন্য গড়ে নেয়ার সুযোগ পায়। অনেক সময় প্রথম বিভাগ ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারেরা এসে শিক্ষার্থীদের সাথে নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেন। শিক্ষার্থীদের জন্য এটি ক্রিকেট শিক্ষাকে পরিপূর্ণতা দেয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে।
Madan Lal Cricket Academy তে ভর্তির যোগ্যতা
সাত থেকে ষোলো বছর বয়সী ছেলেদের প্রশিক্ষণের উপর মদন লাল অ্যাকাডেমিতে বিশেষ জোর দেয়া হয়। ১৬ বছর এর উপরে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হতে চাইলে তাকে ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ভর্তিচ্ছু ক্রিকেটারদেরকে একটি বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হয়। এখানে ক্রিকেটের বিভিন্ন স্কিলে তাদের দক্ষতা মেপে ভর্তি করা হয়।
Madan Lal Cricket Academy এর ভর্তি ফী
মদন লাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে একজন শিক্ষার্থী এককালীন তিন হাজার রুপিতে ভর্তি হতে পারেন। এরপর মাসিক ভিত্তিতে ২০০০ রুপি ফি দিতে হয়। যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়।
Madan Lal Cricket Academy এর অন্যান্য সুবিধা
মদন লাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি শিক্ষার্থীদের সঠিক ক্রিকেটীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করার গুরুত্ব জানে। সাধারণত শিক্ষার্থীদেরকে নিজেদের সরঞ্জাম নিয়ে আসার কথা বলা হয়। এছাড়াও প্রয়োজনমত তাদেরকে সরঞ্জাম দেয়া হয়। প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের আর্থিক অসচ্ছলতা থাকলে সেক্ষেত্রে বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। সাধারণত দরিদ্র পরিবার থেকে আসা ছেলেদের জন্য এই সুযোগ রয়েছে।
Madan Lal Cricket Academy এর অর্জন
মদন লাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশের ক্রিকেটীয় অবকাঠামোয় বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার এই একাডেমি থেকে ক্রিকেটের শিক্ষা নিয়ে আঞ্চলিক ক্রিকেটে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে। অ্যাকাডেমির অন্যতম সফল শিক্ষার্থী হলেন বৈভব কান্দপাল। তিনি ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের পাশাপাশি দিল্লীর রঞ্জি টিমে খেলেছেন। এখানে ক্রিকেটারদেরকে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও স্পোর্টসম্যানশিপের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা হয়।
Madan Lal Cricket Academy তেই কেন?
কোনো তরুণ ক্রিকেটারকে সঠিক পরিবেশে গড়ে তোলার জন্য মদন লাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখানে ভর্তি হবার কারণ হলোঃ
বিশেষজ্ঞ কোচিংঃ এখানে মদন লালের মতন অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের অধীনে ক্রিকেট শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। তিনি ছাড়াও অন্য সব কোচও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন যারা অমূল্য পাথেয় ও দিকনির্দেশনা দেবার যোগ্যতা রাখেন।
মানের উপর গুরুত্বঃ অল্প শিক্ষার্থী নেয়ায় মান বজায় থাকে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা করে সময় বরাদ্দ থাকে। এতে কোচিংয়ের মান ভালো হয়।
কাঠামোবদ্ধ শিক্ষাঃ এখানকার কাঠামোবদ্ধ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। ফিটনেস, দক্ষতা ও মানসিক দৃঢ়তা মিলে একটি সামগ্রিক ক্রিকেট শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা অগ্রসর হবার সুযোগ পায়।
আধুনিক প্রশিক্ষণের সুবিধাঃ কয়েক ধরণের পিচ থাকায় একজন উদীয়মান ক্রিকেটার বিভিন্ন ধরণের কন্ডিশনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার শিক্ষায় বেড়ে ওঠে। এর ফলে তার প্রতিভার পরিপূর্ণভাবে প্রস্ফুটিত হবার সুযোগ পায়।
টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগঃ মদন লাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে খেলা প্রতিটি ক্রিকেটার আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। বিভিন্ন স্কুল ও অঞ্চলভিত্তিক টুর্নামেন্টে তারা নিয়মিতভাবে নিজেদের মেধা যাচাই করার সুবিধা লাভ করে। এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে একজন উদীয়মান ক্রিকেটার বেড়ে ওঠে।
উপসংহার
ক্রিকেটের উন্মাদনা ও ক্রিকেটারের সংখ্যায় ভারত ক্রিকেট বিশ্বের অন্য সব দলকে সহজেই পেছনে ফেলেছে। বর্তমানে ভারতের প্রতিটি বয়সভিত্তিক দলে জায়গা পাওয়ার জন্য একজন ক্রিকেটারকে তুমুল প্রতিযোগিতা করতে হয়। বর্তমানে ক্রিকেট শিক্ষায় সন্তানকে কিছুটা এগিয়ে রাখতে বাবা-মায়েরা একাডেমির দিকে ঝুঁকছেন। কাঠামোবদ্ধ শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা যাতে মেধা বিকাশের জন্য উপযোগী পরিবেশ পায় সেটাই একাডেমিগুলোর লক্ষ্য হয়ে থাকে। মদন লাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিও অভিন্ন লক্ষ্যে নিজেদের যাত্রা শুরু করে। দিল্লী অঞ্চলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অ্যাকাডেমিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সুযোগ-সুবিধা, অবকাঠামো, ও কোচিংয়ের মানের ভিত্তিতে এটি স্থানীয় সেরা অ্যাকাডেমিগুলোর কাতারে থাকবে। কিছুদিন পরেই হয়তো এই অ্যাকাডেমি ভারতকে তার ক্রিকেট তারকা উপহার দেবে।