বর্তমান দ্রুতগতির বিশ্বে ক্রিকেটের ব্যাপ্তি হয়ে উঠছে সংক্ষিপ্ততর। ফ্র্যাঞ্জাইজির এই যুগে দর্শকেরা প্রতিটি দলেই নাটকের পালাবদল দেখতে সক্ষম হয়। ১২০ বল পেরিয়ে ক্রিকেট এখন খেলা হয় মাত্র ষাট বলে। ব্যাট-বলের এই জমজমাট লড়াইয়ের একটি সফল উদাহরণ হলো diamond cricket league t10। আবুধাবিভিত্তিক এই টুর্নামেন্টে বছরের শেষে ১২ দিনের জন্য ক্রিকেট বিশ্বের সেরা তারকারা আবুধাবিতে ভিড় জমায়ে নিজেদের ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করার জন্য।
Diamond Cricket League T10 এর পরিচিতি
Diamond cricket league t10 অথবা আবুধাবি টি১০ লীগ হচ্ছে আরব আমিরাতের টি-টোয়েন্টি লীগ যেটি পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। টি-টোয়েন্টি স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টের অধীনে এই লীগটি পরিচালিত হয়। আমিরাতের ক্রিকেট বোর্ডের সম্মতিক্রমে এর আয়োজন করা হয়। প্রতিটি ম্যাচে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জন্য ১০ ওভার করে বরাদ্দ থাকে। প্রতি ম্যাচের দৈর্ঘ্য আনুমানিকভাবে নব্বই মিনিট হয়ে থাকে। প্রথমে রাউন্ড রবিন ফর্মেটে ম্যাচ হয়, এরপর এলিমিনেটর, এরপর সবশেষে ফাইনাল খেলার মাধ্যমে মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হয়। ২০১৭ সালে এই টুর্নামেন্টটি আলোর মুখ দেখে। ২০১৮ সালে আইসিসি এই টুর্নামেন্টকে “আধা-পেশাদার” হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছে।
সময়ের সাথে সাথে এই টুর্নামেন্টটিকে ঘিরে দর্শকদের আগ্রহ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েই চলেছে। ২০২১-২২ মৌসুমে টেলিভিশন এবং ডিজিটাল স্ট্রিমিং মাধ্যমে এই টুর্নামেন্ট দেখেছে ৩৪.২০ কোটি দর্শক। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩.৭ কোটি। এই লীগের অর্থনৈতিক মূল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ কোটি মার্কিন ডলারে। আমিরাতে ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করতে এই টুর্নামেন্টটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০১৭ সালে টি১০ লীগের চেয়ারম্যান সাজি উল মুলক এই লীগের প্রতিষ্ঠা করেন।
Diamond Cricket League T10 এর ইতিহাস
টি১০ লীগের ধারণাটি বিখ্যাত আমিরাতি ব্যবসায়িক ও ক্রীড়ানুরাগী সাজি উল মুলকের মস্তিষ্কপ্রসূত। তিনি দুবাইভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মারুফ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ফ্র্যাঞ্জাইজি ক্রিকেটের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার বিষয়টি অনুভব করেন। ভারতের আইপিএল, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লীগ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগ বিশ্বজুড়ে ক্রিকেট মহলে ব্যাপক সমাদৃত। তিনি আবুধাবিতে এমন একটি লীগের প্রয়োজনীয়তা টের পান। একটি টুর্নামেন্টের স্বপ্ন দেখা শুরু করেন যেখানে বিশ্বসেরা ক্রিকেটারেরা তাদের প্রতিভা দেখাবে। আর আবুধাবির ক্রিকেটপাগল দর্শকেরা গ্যালারিতে গিয়ে চর্মচক্ষুতে নিজেদের পছন্দের তারকাকে দেখবে।
মাসের পর মাস পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এই লীগের সূচনা হয়। প্রথম ম্যাচটি আবুধাবিতে অবস্থিত শেখ আবু যায়েদ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী মৌসুমে ছয়টি দল অংশগ্রহণ করে। প্রতিটি দলের মালিকই আবুধাবির একেকজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা।
Diamond Cricket League T10 এর ফর্মেট
Diamond cricket league t10 এর খেলাগুলো রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি দল একে অপরের সাথে মুখোমুখি হয়। এরপর পয়েন্ট টেবিলের সেরা চার দল প্লে-অফের জন্য কোয়ালিফাই করে। এরপর কোয়ালিফায়ার, এলিমিনেটরের মাধ্যমে দুটি দল ফাইনালে খেলার সুযোগ লাভ করে। এরপর এক ম্যাচের ফাইনালে মৌসুমের সেরা দল নির্বাচিত হয়।
Diamond Cricket League T10 এর ভেন্যু
এই লীগটি পুরো আরব আমিরাত জুড়ে বিভিন্ন স্টেডিয়ামে হয়ে থাকে। এর ভেন্যুগুলো হচ্ছেঃ
শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামঃ বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত স্টেডিয়াম। এখানে বহু আন্তর্জাতিক ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে।
শেখ যায়েদ স্টেডিয়ামঃ আবুধাবিতে অবস্থিত এই স্টেডিয়ামটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আরেকটি জনপ্রিয় ভেন্যু।
রশিদ স্কুল গ্রাউন্ডঃ দুবাইয়ের এর স্টেডিয়ামে ইতোপূর্বে ঘরোয়া অনেক ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে।
Diamond Cricket League T10 এর সময়কাল
এই রোমাঞ্চকর লীগটি সাধারণত নভেম্বরের শেষে শুরু হয়ে ডিসেম্বরের প্রথম দশ দিনের মধ্যে শেষ হয়। মাত্র এগারো দিনের মধ্যে সবগুলো খেলা হয়। দর্শকেরা অল্প সময়ের মধ্যেই অনেকগুলো উত্তেজনায় ঠাসা ম্যাচের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে। ক্রিকেটীয় বার্ষিক ক্যালেন্ডারের সমাপ্তি টানার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। ক্রিকেট অনুরাগীরা বিরতি ছাড়াই একইদিনে অনেকগুলো ম্যাচ দেখতে পারে।
Diamond Cricket League T10 এর ক্রিকেটে প্রভাব
ক্রিকেটে এই লীগের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে। এর মাধ্যমে খেলার প্রতি স্থানীয় অধিবাসীদের মনোভাব পরিবর্তিত হচ্ছে। সংক্ষিপ্ততম সংস্করণের এই টুর্নামেন্ট দেখতে স্টেডিয়ামে ভিড় জমাতে শুরু করেছে আমিরাতিরা। এইদিকে টেলিভিশন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও এই লীগের জমজমাট ম্যাচ দেখতে উদগ্রীব তাকিয়ে থাকে অন্যান্য দেশের দর্শকেরা। প্রতিটি ম্যাচেই গ্যালারিভর্তি দর্শকেরা আনাগোনা দেখা যায়। আমিরাতে অভিবাসী হিসেবে বসবাস করা উপমহাদেশীয়দের মধ্যে এই লীগ তুমুল্ভাবে জনপ্রিয়। ক্রিকেটের উপর এই লীগের সামগ্রিক প্রভাবগুলো হচ্ছেঃ
- এই লীগের মাধ্যমে বিশ্বের সবপ্রান্ত থেকে সেরা প্রতিভাগুলো ক্রিকেট খেলার জন্য আবুধাবিতে জমায়েত হয়।
- স্থানীয় খেলোয়াড়দেরকে নিজেদের জাত প্রমাণ করার জন্য এটি একটি বড় সুযোগ।
- ক্রিকেটারদের আর্থিক নিশ্চয়তা লাভ।
- অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কারণে অন্যান্য খেলার ভক্তরাও এই ফর্মেটকে সাদরে গ্রহণ করে নিচ্ছে।
- স্থানীয় ও বিশ্বব্যাপী ভক্তদের মধ্যে টি-১০ ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
- নতুন নতুন ভক্ত ও বিজ্ঞাপন বাজারের কাছে ক্রিকেটকে পৌঁছে দিচ্ছে।
Diamond Cricket League T10 এর বিদেশি খেলোয়াড়ের নিয়ম
অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগের মতন বিদেশি খেলোয়াড় নিয়ে এই লীগে তেমন বাধ্যবাধ্যকতা নেই। দলের এগারো জনের মধ্যে দশজন বিদেশি খেলোয়াড় খেলানো যেতে পারে। তার মানে দলগুলোতে মাত্র একজন করে আমিরাতি খেলোয়াড় খেললেই সেটি গ্রহণযোগ্য হবে।
Diamond Cricket League T10 এর নিয়ম
টি-টোয়েন্টি লীগের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে যা ক্রিকেটের অন্যান্য ফর্মেটের চেয়ে আলাদা। সেগুলো হলোঃ
- একজন বোলার সর্বোচ্চ দুই ওভার বল করতে পারবেন।
- পাওয়ারপ্লে হবে প্রতি ইনিংসের প্রথম তিন ওভার।
- টাই হওয়া ম্যাচের শেষে সুপার ওভারের মাধ্যমে জয়ী নির্ধারণ করা হবে। সুপার ওভারেও টাই হলে সেই টাই না ভাংগা পর্যন্ত সুপার ওভার হয়েই যাবে।
Diamond Cricket League T10 এর বর্তমান দলসমূহ
দলের নাম | প্রথম মৌসুম | অধিনায়ক |
বাংলা টাইগার্স | ২০১৯ | সাকিব আল হাসান |
চেন্নাই ব্রেভস | ২০২১ | জেসন রয় |
ডেকান গ্ল্যাডিয়েটরস | ২০১৯ | নিকোলাস পুরান |
দিল্লী বুলস | ২০১৯ | কুইন্টন ডি কক |
মরিসভীল স্যাম্প আর্মি | ২০২২ | ফাফ ডুফ প্লেসি |
নিউ ইয়র্ক স্ট্রাইকার্স | ২০২২ | কিরন পোলার্ড |
নর্দার্ন ওয়ারিয়র্স | ২০১৮ | ওয়ানিন্দু হাসারাংগা |
টিম আবুধাবি | ২০১৯ | ফিল সল্ট |
Diamond Cricket League T10 এর রোল অফ অনার
এখন পর্যন্ত এই লীগের সাতটি আসর মাঠে গড়িয়েছে। চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স-আপ দলের তালিকাটি নিম্নরূপঃ
আসর | জয়ী | রানার্স-আপ |
২০২৩ | নিউ ইয়র্ক স্ট্রাইকার্স | ডেকান গ্ল্যাডিয়েটরস |
২০২২ | ডেকান গ্ল্যাডিয়েটরস | নিউ ইয়র্ক স্ট্রাইকার্স |
২০২১-২২ | ডেকান গ্ল্যাডিয়েটরস | দিল্লী বুলস |
২০২১ | নর্দার্ন ওয়ারিয়রস | দিল্লী বুলস |
২০১৯ | মারাঠি আরাবিয়ানস | ডেকান গ্ল্যাডিয়েটরস |
২০১৮ | নর্দান ওয়ারিয়রস | পাখতুনস |
২০১৭ | কেরালা কিংস | পাঞ্জাবি লেজেন্ডস |
উপসংহার
বর্তমানে ক্রিকেট উপস্থাপিত হচ্ছে ছোট প্যাকেজ আকারে। সময় ও ওভারের ব্যাপ্তি কমে যাওয়াতে প্রথম বল থেকেই ব্যাটসম্যানেরা মারমুখী খেলা শুরু করে। এমন আক্রমণাত্মক খেলা দেখে গ্যালারিতে ওঠে উন্মাদনার ঢেউ। একেকটি বলে যেন নতুন নতুন নাটক। এই সেকেন্ডের জন্যও সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ নেই। এই ডায়মন্ড টি১০ লীগও আবুধাবিতে ক্রিকেটের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমিরাতের আকাশে এই টুর্নামেন্ট এনেছে ক্রিকেটীয় তারার মেলা। প্রথম আসরের সফলতার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাতটি আসর আয়োজিত হয়েছে। বেড়েছে ব্যাপ্তি, দর্শকের সংখ্যা বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। মানুন অথবা না-ই মানুন, ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ আসলে সংক্ষিপ্ত সংস্করণে।