উপমহাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের উন্মাদনা সবচেয়ে বেশি আর জোরালোভাবে নজরে পরে যখন প্রিয় দল ঘরের মাঠে হেরে যায়। মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম হোক, বা কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স, এমনকি লর্ডস-এর মাটিতে ইংল্যাণ্ড জাতীয় ক্রিকেট দলের পরাজয় দেশবাসি যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না, এমনক এই কারণে তাদের সহিংস হয়ে ওঠার ঘটনাও ক্রিকেট ইতিহাসে বিরল নয়। আবার অন্যদিকে নিজ দলকে সমর্থন করতেও নিজের স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকদের তুলনা হয় না। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম-ও এই দ্বিতীয় কারণের জন্যই বেশি খ্যাতি অর্জন করেছে।
শেরে-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেট শুধুমাত্র একটি খেলা নয়, এটা এমন একটা আবেগ যে স্টেডিয়ামের পরিবর্তনের জন্যও এই উপমহাদেশের মানুষ তীব্র প্রতিবাদ জানাতে একটুও দ্বিধা করেনা। ২০০৪ সালে ‘হোম অফ বাংলাদেশ ক্রিকেট‘ নামে খ্যাত এই স্টেডিয়ামটিকে সম্পূর্ণরূপে শুধুমাত্র ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের জন্য ব্যবহার করার উদ্দ্যেশ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, মতিঝিলে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে ক্রিকেটের স্থান পরিবর্তন করে এখানে নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ছিল সেই সময়ে দেশের সবচেয়ে আধুনিক ও উন্নত সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন স্টেডিয়াম। তাই ফুটবলাররা নিজেদেরকে অবহেলিত মনে করায় দ্বন্দ্বের শুরু হয়।
শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটের জন্য মিরপুরের এই স্টেডিয়ামটিকেই স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তবে শুরুতে এই মাঠটি ছিল চৌকোণা এবং ফুটবল ও অন্যান্য অ্যাথলেটিক্স খেলাধুুলার জন্য এটি ব্যবহার করা হতো। ১৯৪০ এর দশকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের নামানুসারে এই স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়। ১৯৮৭ সালের এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজনের মধ্যে দিয়ে এই মাঠে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-কে, ন্য়াশনাল স্পোর্টস্ কাউন্সিল কর্তৃক, নারী ও পুরুষ উভয়ের জাতীয় ক্রিকেট দলের জন্য এই স্টেডিয়ামটি পরিচালনার কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়।
উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক ও অন্যান্য ম্যাচ
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে নতুনভাবে গড়ে তোলা এই মাঠে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হয় যা ছিল বাংলাদেশ ও জিম্বাবুই-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত একদিনের ম্যাচ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত ২০০৭ সালের মে মাসের টেস্টটি ছিল এই স্টেডিয়ামে আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ। আর এখানে আয়োজিত প্রথম টিটোয়েন্টি ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইণ্ডিজ-এর মধ্যে ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে।
এখনো পর্যন্ত এই মাঠে আয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টের মধ্যে ২০১১ সালের একদিনের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল সহ মোট ৫ টি ম্যাচ, ২০১২ ও ২০১৪ ও ২০১৬ সালের এশিয়া কাপ, ২০১৪ সালের টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল এবং নারীদের টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) এর বেশিরভাগ ম্যাচও এখানেই আয়োজিত হয়ে থাকে।
গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক
২০১৭-১৮ সময়কালে এই স্টেডিয়ামে আয়োজিত বাংলাদেশ ট্রাই-ন্যাশন সিরিজের ১৭ জানুয়ারির ম্যাচটি ছিল এই মাঠের ১০০তম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম ১০০ টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের গর্বিত কৃতিত্ব অর্জনকারী বিশ্বের ৬ষ্ঠ স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামটি উদ্বোধন হওয়ার পরে, বিশ্বের সকল স্টেডিয়ামের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত ১০০টি ওডিআই ম্যাচ আয়োজনের কৃতিত্ব অর্জন করে।
২০২৩ সালের ৩ মার্চ এই স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ও ইংল্যাণ্ডের মধ্যে অনুষ্ঠিত ২য় একদিনের আন্তর্জাতিক ম্য়াচটি আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই মাঠে পুরুষদের ২০০ টি ওডিআই ম্যাচ আয়োজনের মাইলফলক অর্জিত হয়, যা একই সাথে এই স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ পুরুষ জাতীয় দলের খেলা ১০০তম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। অন্যদিকে, ২০২৩ সালের ১৪-১৮ জুন বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশের নাজমুল হোসেন শান্ত‘র করা ১০০ রানের ইনিংসটি ছিল তিনটি আন্তর্জাতিক ধরনের ক্রিকেট ম্যাচ মিলিয়ে এই স্টেডিয়ামে ঘটা ১০০তম ১০০ রানের ইনিংস।
শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম, মিরপুর, ঢাকা
মিরপুর স্টেডিয়াম: সুযোগ-সুবিধাসমূহ
ফুটবল মাঠ থেকে ক্রিকেট মাঠে রূপান্তর
মিরপুরের শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের দৈর্ঘ্য ১৮৬ মি. এবং প্রস্থ ১৩৬ মি.। ফুটবলের চৌকোণা মাঠ থেকে ক্রিকেটের জন্য উপযোগী মাঠ তৈরির জন্য প্রচুর ভাঙাভাঙ্গি ও উচ্ছেদ কাজ করা হয়। অ্যাথলেটিক্স এর জন্য ব্যবহৃত ট্র্যাক খোদাই করে তুলে ফেলা হয়। লাল রঙের মাটি সম্পূর্ণরূপে দূর করার জন্য প্রায় ৩ ফিট পর্যন্ত মাটি উপড়ে ফেলা হয়। প্রথমে পিভিসি পাইপ ব্যবহার করে ভরাট কাজ শুরু করা হয়। তারপরে পাথরের টুকরো, বালি ও সবশেষে ঘাস দিয়ে আবৃত করে মাঠকে ক্রিকেট ম্যাচের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। এই কারণে এই মাঠের জলনিষ্কাশন প্রক্রিয়া এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, এমনকি বিশেষজ্ঞদের মতে এই মাঠের এই নিষ্কাশন সুবিধাটি উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা।
সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ
এই মাঠের ঢাল একদম যথাযথ মানের ও মসৃণ, পিচ থেকে সীমানা পর্যন্ত এই ঢালের উচ্চতার পার্থক্য ২৯ ইঞ্চি। ২০০৯ সালে এই স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইট স্থাপন করা হয় যার ফলে এখানে দিনে/রাতে উভয় সময়েই অনায়াসে আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ম্যাচের আয়োজন করা সম্ভব হয়। এই স্টেডিয়ামের আসন সংখ্যা ২৫,৪১৬ যা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সবচেয়ে ছোট স্টেডিয়ামগুলোর প্রায় সমান। ২০১৯-২০ সময়কালে আয়োজিত বিপিএল-এর ফাইনাল ম্যাচে এই স্টেডিয়ামে ২৭,৭২৫ জন দর্শকের সমাগম ঘটে যা এই স্টেডিয়ামের এখন পর্যন্ত সর্ব্বোচ্চ সংখ্য়ক এবং কাগজে-কলেমে এখানকার ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি।
নতুন সংস্কার কাজ
২০১১ সালে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ সহ মোট ৫ টি ম্যাচ আয়োজনের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, এই স্টেডিয়ামের বেশ কিছু নতুন সংস্কারের কাজ করে। স্টেডিয়ামে খেলা দেখানোর জন্য একটি বিশালাকার পর্দা ও বিদ্যুতচালিত স্কোরবোর্ড স্থাপন করা হয়, চিরাচরিত পর্দাগুলো পরিবর্তন করে সেগুলোর স্থানে বিদ্যুতচালিত পর্দা স্থাপন করা হয়, আরও উন্নতমানের ফ্লাডলাইট স্থাপন করা হয়, প্রায় ১৬,০০০ মার্কিন ডলার খরচ করে ইউকে থেকে ‘হোভার ওভার‘ বা বৃষ্টিসহ বৈরী আবহাওয়া থেকে মাঠকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের যন্ত্র নিয়ে আসা হয়।
পুরো স্টেডিয়ামে প্লাস্টিকের আসন স্থাপন করা হয়, প্রায় ২০০ জন সাংবাদিকের স্থান সংকুলান হতে পারে এমন একটি নতুন মিডিয়া সেন্টার গড়ে তোলা হয়। সেই সাথে খেলোয়াড়দের ড্রেসিং রুমও নতুন রূপে সাজানো হয়। এছাড়া প্রধান মাঠের সাথে একটি নতুন ক্রিকেট একাডেমি গড়ে তোলা হয়, যার ফলে আগে থেকে অবস্থিত অভ্যন্তরীন ক্রিকেট প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার সাথে নতুন করে আরও একটি প্রশিক্ষণ স্থান যোগ হয়।
মিরপুর স্টেডিয়ামে সংঘটিত আন্তর্জাতিক রেকর্ড
বাংলাদেশের ‘হোম অফ ক্রিকেট‘ নামে খ্যাত শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ২০০৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন শুরু হওয়ার পর থেকে এখানে নিয়মিতভাবেই ম্যাচের আয়োজন হয়ে আসছে। সুতরাং এই স্টেডিয়াম যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক রেকর্ডও অনুষ্ঠিত হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। আর তা হয়েছে বৈ কি! কয়েকটি নয়, বরং বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক রেকর্ডের সাক্ষী এই স্টেডিয়াম। ঐ সকল রেকর্ডের মধ্যে থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো:
শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে টেস্ট ম্যাচে ২০০ রান করার একটি মুহুর্তে মুশফিকুর রহিম
- ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে খেলা একদিনের ম্যাচে, বাংলাদেশের তাইজুল ইসলাম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসেবে অভিষেকেই হ্যাট-ট্রিকের কৃতিত্ব অর্জন করেন। ২০১৫ সালের ১০ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার কাগিসো রাবাদা, বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলা ম্যাচে, বিশ্বের দ্বিতীয় বোলার হিসাবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন।
- বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে একই স্টেডিয়ামে ৫ টি শতরানের ইনিংস খেলার গৌরব অর্জন করেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক তামিম ইকবাল।
- ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি জিম্বাবুইয়-এর বিপক্ষে খেলা ম্যাচে তামিম ইকবাল, প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ব্যক্তিগত ৬,০০০ রান সংগ্রহের মাইলফলক অর্জন করেন এবং একই সাথে, একটি নির্দিষ্ট স্টেডিয়ামে করা সনথ জয়সুরিয়া‘র (২,৫১৪ রান, আর. প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম) রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়েন।
- ২০১৮ সালের ৩ রা নভেম্বর জিম্বাবুই-এর বিপক্ষে খেলা টেস্ট ম্যাচে, বাংলাদেশের মুশফিকুর রিহম, বিশ্বের প্রথম উইকেট রক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ব্যক্তিগত ২ টি ২০০ রানের ইনিংসের রেকর্ড গড়েন।
- ২০২৩ সালের ৩ মার্চ ইংল্যাণ্ডের বিপক্ষে খেলা ২য় একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে মুশফিকুর রহিম, একটি নির্দিষ্ট মাঠে ১৫০ টি ম্যাচ খেলার কৃতিত্ব অর্জন করেন।