১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল যখন আইসিসি‘র বিশ্বকাপ আসরে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করে, তখনও বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) সসম্পর্কে দেশের বেশিরভাগ মানুষই জানতো না। কিন্তু বিকেএসপি নিজের দায়িত্ব ঠিকই পালন করে যাচ্ছিলো। আজকের দিনে খুব অল্প বয়সী বাচ্চারাও বিকেএসপি সম্পর্কে জানে। এর কারণ শুধু যে ডিজিটাল যুগের বা সামাজিক গণমাধ্যমের যত্রতত্র সর্বত্র বিস্তার রয়েছে তা নয়, বরং সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবাল, মুস্তাফিজুর রহমান-এর মত ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিনিধিত্ব- হোক তা সফল বা হতাশাজনক।
যদিও ক্রিকেট প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিকেএসপি‘তে অন্যান্য খেলাধুলায়ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, এই আর্টিকেলটিতে শুধুমাত্র বিকেএসপি‘র ৪ টি ক্রিকেট গ্রাউণ্ড বা মাঠ নিয়েই আলোচনা করা হবে। তবে তার আগে থাকছে বিকেএসপি সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য।
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ জন্মানো ও বাড়িয়ে তোলা, প্রতিভাকে বিকশিত করা, সর্বপোরি দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সরকার পরিচালিত একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভার-এর জিরাইন-এ এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।
এখানে আগত শিক্ষার্থীদের জন্য সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি, নির্দিষ্ট খেলাধুলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা উচ্চ বিদ্যালয় পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত প্রদান করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণরূপে আবাসিক। এমনকি শিক্ষক ও প্রশিক্ষকেরাও প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণেই বসবাস করেন।
নির্ধারিত ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তবেই এখানে প্রশিক্ষণ লাভ করা সম্ভব। প্রশিক্ষণ প্রদানের ফি নির্ধারণ করা হয় শিক্ষার্থীর পারিবারিক আয়ের উপর ভিত্তি করে। ক্রিকেট, ফুটবল, টেবিল টেনিস, ধনুর্বিদ্যা, অ্যাথলেটিক্স, কারাটে, বক্সিং, জুডো, বাস্কেটবল, সাঁতার, হকি, ভলিবল, জিমন্যাস্টিক্স, টেনিস, তায়কোন্দ, শুটিং সহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার বিষয়ে বিকেএসপি-তে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
বিকেএসপি‘র ৪ টি ক্রিকেট গ্রাউণ্ড
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধীনে বর্তমানে ৪ টি ক্রিকেট গ্রাউণ্ড বা মাঠ রয়েছে। প্রশিক্ষণ নিতে আসা ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনে ব্যবহারের পাশাপাশি, ২০০০ সাল থেকে এই সকল মাঠে বাংলাদেশি ঘরোয়া প্রতিযোগিতার প্রথম শ্রেণীর ও এ-লিস্ট‘র ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এছাড়া এই ৪ টি মাঠে বেশ কয়েকটি ছোট পরিসরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচও আয়োজিত হয়েছে।
গ্রাউণ্ড ১ বা ১ম মাঠটিতে ২০০০ সাল থেকে ঘরোয়া পরিসরের প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ আয়োজিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সহায়তায় গ্রাউণ্ড ২, ৩ ও ৪ এর সুযোগসুবিধা ও অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হয়েছে। এই তিনটি মাঠই ঘরোয়া পরিসরের প্রথম শ্রেণীর ও লিস্ট-এ ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজনে নিরপেক্ষ মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিকেএসপি গ্রাউণ্ড ১
বিকেএসপি প্রাঙ্গণের প্রধান ফটকের ডানদিকে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-এর ১ নং গ্রাউণ্ডটি অবস্থিত। এই মাঠটি ১৯৮০‘র দশক থেকেই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৯৯৬ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন-এর সিনিয়র পর্যায়ের সীমিত ওভারের টুর্নামেন্ট আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই মাঠে প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হয়। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ‘উইল্স ইন্টারন্যাশনাল কাপ‘-এর তিনটি প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ ছিল এই মাঠে আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ।
২০০০-০১ সালের সময়কালে ন্যাশনাল ক্রিকেট লীগ-এ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর হোম গ্রাউণ্ড ছিল এই মাঠ। ঐ টুর্নামেন্টের মাধ্যমেই এখানে প্রথমবার প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ আয়োজিত হয়। এখনও এই মাঠে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন হয়ে থাকে, যদিও তা খুব একটা নিয়মিত তো নয়-ই, সংখ্যায়ও যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশ এ দল এই মাঠে সফরকারী পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এ দলের সাথে যথাক্রমে ২০০১-০২ ও ২০০৫-০৬ সময়কালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছিল। ২০০০-০১ সালে ন্যাশনাল ক্রিকেট লীগের একদিনের ম্যাচ আয়োজনের মাধ্যমে এই মাঠে প্রথমবারের মত এ-লিস্ট ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হয়। এই ধরনের ম্যাচ এখানে এখনও খুব বেশি সংখ্যায় আয়োজিত হয় না।
বিকেএসপি‘র অন্য ৩ টি মাঠ, প্রতিষ্ঠানটির প্রাঙ্গনের আরও ভিতরের দিকে অবস্থিত। ঘরোয়া পরিসরে বড় পর্যায়ের ম্যাচ ছাড়াও এই মাঠগুলোতে ছোট-বড় পর্যায়ের বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচও নিয়মিতভাবেই আয়োজিত হয়ে থাকে, তবে আয়োজিত ম্যাচের সংখ্যা মোটেও যথেষ্ট নয়। এর জন্য সুযোগসুবিধার অপর্যাপ্ততাকে দায়ী করলে খুব একটা ভুল হবে না।
বিকেএসপি গ্রাউণ্ডে মোহামেডান দলের ব্যাটার মুর্শিদা খাতুন
বিকেএসপি গ্রাউণ্ড ২
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-এর ২ নং গ্রাউণ্ড-এ ২০০৬ সালে প্রথমবারের মত ঘরোয়া পরিসরের প্রথম শ্রেণীর ও এ-লিস্ট ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশ এ দল এই মাঠে দুইটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছিল। ২০১৪-১৫ সময়কালের শেষ পর্যন্ত এই মাঠে মোট ১৯ টি প্রথম শ্রেণীর, ২১ টি এ-লিস্ট এবং ৩ টি আন্তর্জাতিক টিটোয়েন্টি ম্যাচ আয়োজিত হয়েছে। ২০১১ সালের নারীদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের কোয়ালিফায়িং সিরিজের ৩ টি ম্যাচও এই মাঠে আয়োজিত হয়েছে। এখানে এখনও ঘরোয়া পরিসরের প্রথম শ্রেণীর ও এ-লিস্ট ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হয়ে থাকে।
বিকেএসপি গ্রাউণ্ড ৩ ও ৪
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-এর ৩ ও ৪ নং গ্রাউণ্ড দুইটি পাশাপাশি অবস্থিত। মাঠ দুইটির পরিচালনায় ও ম্যাচ আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি একই, অর্থাত্ মাঠ দুটিকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সম্পদ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়। উভয় গ্রাউণ্ডেরই আসন সংখ্যা ২০০০। ২০১৩-১৪ সালে যখন প্রথমবারের মত ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগ-এর এ-লিস্ট ম্যাচ এখানে আয়োজিত হয়, খেলোয়াড়েরা এখানে প্রদত্ত সুযোগসুবিধার বেশ সমালোচনা করেছিল। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে, বিকেএসপি‘র ৩ ও ৪ নং গ্রাউণ্ডে শারীরিক প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়দের জন্য আয়োজিত ‘আইসিআরসি ইন্টারন্যাশনাল টি২০ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট‘ অনুষ্ঠিত হয়।
৩ নং গ্রাউণ্ডটি ২০১৩-১৪ সময়কাল থেকেই ঘরোয়া পরিসরের প্রথম শ্রেণীর এবং বিশেষত এ-লিস্ট ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ আয়োজনের অন্যতম প্রধান মাঠ এটি। ২০১৬-১৭ সময়কালের শেষ পর্যন্ত এই মাঠে মোট ১৭ টি প্রথম শ্রেণীর এবং ৯৯ টি লিস্ট-এ ক্রিকেট ম্যাচ আয়েজিত হয়েছে। ২০১১ সালের নারীদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের কোয়ালিফায়িং সিরিজের ২ টি ম্যাচও এই মাঠে আয়োজিত হয়েছে।
অন্যদিকে ৪ নং গ্রাউণ্ডে ২০১৩-১৪ সালে ২ টি ও ২০১৬-১৭ সালে ১ টি প্রথম শ্রেণীর এবং মোট ৩৬ টি লিস্ট-এ ম্যাচ আয়োজিত হয়েছে। ২০১৬-১৭ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ আয়োজনের জন্য ব্যবহৃত তিনটি মাঠের মধ্যে বিকেএসপি ৪ নং মাঠও ছিল। উক্ত টুর্নামেন্টের মোট ২৭ টি লিস্ট-এ ক্রিকেট ম্যাচ এই মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এই দুইটি গ্রাউণ্ডেই সাম্প্রতিক সময়েও ঘরোয়া পরিসরের প্রথম শ্রেণীর ও এ-লিস্ট ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হয়ে থাকে।
সদ্য সমাপ্ত হয়ে যাওয়া টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের হতাশাজনক পার্ফর্ম্যান্স নিয়ে ভাবলে মনে হয়, উপরে বর্ণিত দেশের সর্বোন্নত ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ঠিক একই রকম দু:খজনক। ঘরোয়া পরিসরে বাংলাদেশে আয়োজিত ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে খুব একটা শোরগোল হয় না যেমনটা হয়ে থাকে প্রতিবেশি দেশ ভারতের রঞ্জি ট্রফি বা দুলীপ ট্রফির বেলায়। এই দুই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়েরা যদি জাতীয় দলে স্থান করে নিতে ব্যর্থও হয়, তারপরেও শুধুমাত্র এই দুই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্যই তাদের খ্যাতি দেশ ও দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পরে।
বাংলাদেশে ঘরোয়া পরিসরে আয়োজিত ক্রিকেট ম্যাচের সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি এর যথেষ্ট মাত্রায় প্রচার করে দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। এতে করে আরও বেশি সংখ্যক প্রতিভাবান খেলোয়াড়, যাদের পক্ষে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্ভব নয়, খুঁজে পাওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহ বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাথে জড়িত সকলেই, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)‘র এই ৪টি গ্রাউণ্ডে আরও বেশি সংখ্যক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনে সচেষ্ট হলে, তবে হয়তো সুদিনের দেখা মিলবে।