বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দল বাংলাদেশকে ক্রিকেটে বিরল সম্মান এনে দিয়েছে। সালমা, নাহিদা, নিগারদের বিজয় ক্রিকেটপাগল একটি জাতির মুখে হাসি ফুটিয়েছে। পুরুষদের চেয়ে ক্রিকেটের অঙ্গনে নারীদের পদচারণা দেরিতে শুরু হলেও তাঁরা অর্জনে ছাড়িয়ে গেছে অগ্রজদের। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের পাশাপাশি বিভিন্ন গেমসেও মেডেল জিতে চলেছে। বর্তমান বিশ্বের সেরা দলগুলোর সাথে বাইশ গজে লড়াই করে বাংলার বাঘিনীরা। এশিয়ার গণ্ডি ছড়িয়ে তাঁদের সুনাম এখন বিশ্বব্যাপী। একসময় হয়তো বিশ্বকাপ জিতে চমকে দিতেও পারে নারীরা।
Bangladesh National Women’s Cricket Team ইতিহাস
বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের আনুষ্ঠানিক পথচলাটা শুরু হয় ২০০৭ সালের জুলাই মাসে। তখন থাইল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচের দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতে শুভসূচনা করে বাংলাদেশ। এরপর সেই বছরেও এসিসি নারী টুনার্মেন্টে অংশগ্রহণ করে সেখানেও বিজয় অর্জন করে। ২০১১ সালের নারী বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে পঞ্চম স্থান অর্জন করার সুবাধে আইসিসি বাংলাদেশকে ওয়ানডে স্ট্যাটাস প্রদান করে। আমেরিকা যুক্তরাষ্টের বিপক্ষে নয় উইকেটে জয়ের সুবাধে তাদেরকে এই মর্যাদা প্রদান করা হয়। এই জয়ের মাধ্যমে টুর্নামেন্টে তাঁদের ষষ্ঠ ও বিশ্বে দশম স্থান নিশ্চিত হয়। ২০১৪ সালে তাঁরা স্বাগতিক হিসেবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে। এটি ছিল বড় কোনো আসরে তাঁদের প্রথম অংশগ্রহণ। সেই বিশ্বকাপে পাঁচ ম্যাচের দুটিতে তাঁরা জয়লাভ করে। এরপর চারটি আসরে অংশগ্রহণ করলেও তাঁদের আর ম্যাচ জেতা হয়নি। ২০২২ সালে তাঁরা প্রথমবারের মতন ওয়ানডে বিশ্বকাপে অংশ নেবার সুযোগ পায়। সেই টুর্নামেন্টে তাঁরা সাত ম্যাচ খেলে একবার জয়ের দেখা পায়। আর ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দল খেলেছে।
এশিয়া কাপে বাংলাদেশের পারফর্মেন্স আশাব্যঞ্জক। ২০২২ সালের আসর পর্যন্ত তারা ২১ ম্যাচ খেলে ১২টিতে জয় পেয়েছে। একবার চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব লাভ করেছে। ২০১২ সালে চীনে অনুষ্ঠিত আসরের সেমিফাইনালিস্ট ছিল বাংলার মেয়েরা। সর্বশেষে ২০২২ এর আসরে তাঁরা স্বাগতিক ছিল। ছয় ম্যাচে দুই জয়ে তাঁরা পঞ্চম স্থানে থেকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়। বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল ২০১১ সালের ২৬শে নভেম্বরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলে। সেই ম্যাচে ৮২ রানে জিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের শুভসূচনা করে। বিদেশের মাটিতে প্রথম ম্যাচ জেতার জন্য বাংলাদেশকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আয়ারল্যান্ডকে তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে ম্যাচে দশ রানে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে ম্যাচ জেতে বাংলার মেয়েরা। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিততে অবশ্য এতোটা অপেক্ষা করতে হয়েনি। ২০১৪ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে। দুই ম্যাচের সিরিজে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করেই সিরিজ জিতে নেয় তাঁরা।
Bangladesh National Women’s Cricket Team অর্জন
বাংলাদেশের জাতীয় নারী ক্রিকেট দল অর্জনে পুরুষদের ছাপিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেট দলের অর্জন বলতে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজের ট্রফি। অন্যদিকে নারীদের রয়েছে এশিয়ার সেরা হওয়ার গৌরব। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত নারী এশিয়া কাপে বাংলাদেশ ভারতের একাধিপত্য খর্ব করে শিরোপা জেতে। প্রথমপর্বের পাঁচ ম্যাচের চারটিতে জিতে বাংলাদেশ ফাইনালে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করে। কিন্তু ফাইনালে তাঁদের প্রতিপক্ষ ছিল প্রবল পরাক্রমশালী। পূর্ববর্তী সাত আসরের প্রতিটিতে ভারত নিজেদের ঘরে শিরোপা তুলেছিল। এমনকি ভারত বাদে এশিয়ার অন্য কোনো দলই শিরোপা জয় করতে সক্ষম হয়নি। কুয়ালামপুরে এক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ভারতকে তিন উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ শিরোপা জয় করে। দেশে উল্লাসের বন্যা বয়ে যায়। ভারতের হয়ে খেলা বিশ্বতারকাদের ঘটিয়ে নিগার, সালমারা যেন বিশ্বমঞ্চে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছিল।
সাউথ এশিয়ান গেমসেও বাংলাদেশ তাঁদের সাফল্যের ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। ২০১৯ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ স্বর্ণপদক লাভ করে। একই আসরে পুরুষেরাও স্বর্ণপদক জেতে। ২০২২ সালে এশিয়ান গেমসের পরবর্তী আসরে বাংলাদেশ ব্রোঞ্জপদক লাভ করে। এখন পর্যন্ত এশিয়ান গেমসে তিনবার পদক জিতেছে বাংলার বাঘিনীরা। ২০১০ সালে গুয়াংজুতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ রৌপ্যপদক লাভ করে। এরপর ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিওনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে আবার একই পদক লাভ করে তাঁরা। হাংজুতে অনুষ্ঠিত ২০২২ সালের এশিয়ান গেমসে তাঁরা ব্রোঞ্জপদক পায়। আর ২০১৯ সালে নেপালে সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক লাভ করে ইতিহাস রচনা করে বাংলাদেশের মেয়েরা।
Bangladesh National Women’s Cricket Team রেকর্ড
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল এখন পর্যন্ত ৬৬টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছে। তাঁরা এর মধ্যে ১৭টি ম্যাচে জয়লাভ করেছে তাঁরা। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের রেকর্ড আরো প্রশংসনীয়। এখন পর্যন্ত ১১৮ ম্যাচ খেলে ৪৩টি ম্যাচে জয়লাভ করেছে তাঁরা।
ওয়ানডে ম্যাচে বাংলাদেশ নারী দলের কিছু রেকর্ড
- সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহঃ ২৫০/৩ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০২৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর
- সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহঃ ১০৭ ফারজানা হক বনাম ভারত, ২০১৩ সালের ২২শে জুলাই
- সেরা বোলিংঃ ৬/২০, খাদিজা তুল কুবরা বনাম পাকিস্তান, ৬ই অক্টোবর ২০১৮
Bangladesh National Women’s Cricket Team এর পক্ষে সর্বোচ্চ ওয়ানডে রান
খেলোয়াড়ের নাম | রান | গড় | ক্যারিয়ার কাল |
ফারজানা হক | ১৫০৭ | ২৬.৪৩ | ২০১১-১৪ |
রুমানা আহমেদ | ৯৬৩ | ২২.৯২ | ২০১১-২০২২ |
নিগার সুলতানা | ৮৯৭ | ২৩.৬৯ | ২০১৫-২০২৪ |
শারমিন আক্তার | ৫৬২ | ১৬.৫২ | ২০১১-২০২৩ |
সালমা খাতুন | ৪৯১ | ১৪.৪৪ | ২০১১-২০২২ |
Bangladesh National Women’s Cricket Team এর পক্ষে সর্বোচ্চ ওয়ানডে উইকেট
খেলোয়াড়ের নাম | উইকেট | গড় | ক্যারিয়ার কাল |
নাহিদা আক্তার | ৫৩ | ২২.৬৭ | ২০১৫-২০২৪ |
সালমা খাতুন | ৫২ | ২২.৬৯ | ২০১১-২০২২ |
রুমানা আহমেদ | ৫০ | ২৫.৪৬ | ২০১১-২০২২ |
জাহানারা আলম | ৪৮ | ৩০.৩৯ | ২০১২২-২০২৩ |
খাদিজা তুল কুবরা | ৪২ | ১৯.৮৫ | ২০১১-২০২১ |
টি-টোয়েন্টি ম্যাচে বাংলাদেশ নারী দলের কিছু রেকর্ড
সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহঃ ২৫৫/২ বনাম মালদ্বীপ, ৫ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সাল
সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহঃ ১১৩*, নিগার সুলতানা বনাম মালদ্বীপ, ৫ই ডিসেম্বর, ২০১৯
সেরা বোলিংঃ ৫/১২, নাহিদা আক্তার বনাম কেনিয়া, ১৯ জানুয়ারি, ২০২২
Bangladesh National Women’s Cricket Team এর পক্ষে সর্বোচ্চ টি-টোয়েন্টি রান
খেলোয়াড়ের নাম | রান | গড় | ক্যারিয়ার কাল |
নিগার সুলতানা | ১৮০২ | ২৫.৩৮ | ২০১৫-২০২৪ |
ফারজানা হক | ১২৫৩ | ১৮.৭০ | ২০১২-২০২৩ |
শামীমা সুলতানা | ৮৬৪ | ১৪.১৬ | ২০১২-২০২৩ |
রুমানা আহমেদ | ৮৫৪ | ১৩.১৩ | ২০১২-২০২৩ |
আয়েশা রহমান | ৭০০ | ১৩.৭২ | ২০১৩-২০২০ |
Bangladesh National Women’s Cricket Team এর পক্ষে সর্বোচ্চ টি-টোয়েন্টি উইকেট
খেলোয়াড়ের নাম | উইকেট | গড় | ক্যারিয়ার কাল |
নাহিদা আক্তার | ৯৪ | ১৬.৯১ | ২০১৫-২০২৪ |
সালমা খাতুন | ৮৪ | ১৮.৫৭ | ২০১২-২০২৩ |
রুমানা আহমেদ | ৭৫ | ১৮.৭০ | ২০১২-২০২৩ |
জাহানারা আলম | ৫৭ | ২৩.৩১ | ২০১২-২০২৩ |
ফাহিমা খাতুন | ৪৯ | ২৫.০৬ | ২০১৩-২০২৪ |
উপসংহার
এত অর্জনের পরেও বাংলাদেশে নারীদের ক্রিকেট খেলা অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে যোজন যোজন পিছিয়ে আছে। অর্থায়নের অভাবে পুরুষদের তুলনায় নারীরা সিকিভাগ সুযোগও পায় না। দেশের সাধারণ মানুষের মনোভাবও এই ক্ষেত্রে একটি বড় প্রভাবক। বাংলাদেশের নারী দলের অর্জনে সবাই বাহবা দেয়। কিন্তু এখনো নারীদের খেলায় অংশগ্রহণকে সমাজ বাঁকা চোখে দেখে। শতকরা ৯৯ভাগ বাবা-মাই নিজের মেয়েকে মাঠে বা ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে পাঠাতে নারাজ। সাধারণ মেয়েরা তো বটেই, জাতীয় ক্রিকেট দলের মেয়েদেরকেও প্রতিনিয়ত শত প্রতিকূলতার বিপক্ষে যুদ্ধ করে যেতে হয়। তবুও এগিয়ে যাচ্ছে দেশের ক্রিকেট। মেয়েরা ট্রফি এনে দিচ্ছে, শত বাঁধা অতিক্রম করে গড়ে যাচ্ছে নতুন রেকর্ড।