ভারতের মুম্বাই শহরের ক্রিকেটের জন্য বিখ্যাত। এই শহরের অলি-গলি, মহাসড়ক, ছাদ কিংবা ময়দান – সবজায়গায় নিরন্তর ক্রিকেটের চর্চা চলে। মুম্বাইয়ের ময়দানে খেলে অনেক ভারতীয় ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য অর্জন করেছেন। এখনো লাখো শিশু-কিশোর-তরুণ স্বপ্ন দেখেন ক্রিকেটের স্বপ্নটা ছুঁয়ে দেখার। ভারতের বিখ্যাত আকাশি জার্সিতে মাঠ কাঁপানোর আশায় তারা সকাল-সন্ধ্যা অনুশীলনে ব্যস্ত থাকে। ক্রিকেটের প্রতিভাকে সঠিকভাবে চর্চা করার জন্য মুম্বাইয়ে অনেকগুলো ক্রিকেট একাডেমি গড়ে উঠেছে। এইসব একাডেমিতে উন্নতমানের কোচিংয়ে শিশুদের মেধা বিকশিত হবার সুযোগ পায়।
Cricket Academy in Mumbai এর পরিচয়
পঞ্চাশের দশক থেকে মুম্বাই শহরে ক্রিকেটে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার শুরু হয়। তখন থেকে একজন ক্রিকেটীয় গুরু বা পণ্ডিতের অধীনে কয়েকজন ছাত্র অনুশীলন করতো। এরপর আস্তে আস্তে সুযোগ সুবিধা বাড়তে থাকে। আশির দশকে ভারত জাতীয় ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে একাডেমির ব্যাপ্তি বিস্তৃত হয়। বর্তমানে আবাসন সুবিধাসহ একটি ক্রিকেট একাডেমিতে একজন উঠতি খেলোয়াড় সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা পায়। মাসিক ফী এর ভিত্তিতে প্রতিটি একাডেমিতে উঠতি প্রতিভাদেরকে ভর্তি করানো হয়।
Cricket Academy in Mumbai এর সেরা প্রতিষ্ঠানগুলো
বর্তমানে শুধু মুম্বাই শহরেই দেড়শ এর উপর ক্রিকেট অ্যাকাডেমি চালু আছে। সেখানে তৈরি হচ্ছে আগামীদিনের গাভাস্কার, শচীনেরা। এদের মধ্যে সেরা একাডেমিগুলো হলোঃ
১। শিবাজি পার্ক জিমখানা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি
শিবাজি পার্ক জিমখানা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি মুম্বাইয়ের ক্রিকেটীয় জগত এক দৈব্যতুল স্থান। এই ক্রিকেট অ্যাকাডেমিটি ভারতের ক্রিকেটে “নার্সারি অফ ক্রিকেট” নামে পরিচিত। এখন পর্যন্ত এই একাডেমি থেকে ২১ জন খেলোয়াড় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেছে।অজিত আগারকার, সন্দীপ পাতিল, প্রবীণ আমরে, সুনীল গাভারস্কারসহ আরো অনেকে এই একাডেমিতে ক্রিকেটে হাতেখড়ি নিয়েছেন। শচীন টেন্ডুলকারও জিমখানাতে গুরু রমাকান্ত আচরেকারের দেখানো পথে ক্রিকেটের ইতিহাসে ঢুকে গেছেন। এই একাডেমিকে ভারতের অন্যতম সেরা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯০৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জিমখানাতে পেশাদার ক্রিকেট পিচ আছে। এখানে সব ধরণের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। বর্তমান ও সাবেক ক্রিকেটারদের মধ্যে অনেকেই এই অ্যাকাডেমি দেখতে আসেন।
২। চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত ক্রিকেট ক্লিনিক
এই ক্রিকেট অ্যাকাডেমিটি ১৯৯৯ সালের অক্টোবরের ১৭ তারিখে শ্রী চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন রমাকান্ত আচরেকারের একনিষ্ঠ শিষ্য। তিনি একসময় ক্রিকেট খেলেছেন। এরপর ক্রিকেটের কোচও ছিলেন। রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দলের কোচ হিসেবে চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত সুনাম কুড়িয়েছেন। এই অ্যাকাডেমি থেকে শিভাম দুবে, আহমেদ নিজাম উঠে এসেছেন। এই অ্যাকাডেমিতে খেলার পাশাপাশি একজন ভালো মানুষ গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়া হয়। এখানে সপ্তাহে পাঁচদিন ক্রিকেটের দীক্ষা নেয় শিশু-কিশোরেরা। এর ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য মুম্বাইতে সর্বজনবিদিত।
৩। এমআইজি ক্রিকেট ক্লাব
১৯৬০ সালে এমআইজি ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। ষাটের দশকে স্থানীয় ক্রিকেটার ও ক্রীড়ামোদীদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধা ছিল না। তাই এর ফলশ্রুতিতে এই অ্যাকাডেমি খোলা হয়। এমআইজি মুম্বাইয়ের অন্যতম পুরনো ক্রিকেট ক্লাব। বড় টুর্নামেন্টে তাদের ভালো অর্জন রয়েছে। এই ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ১৪,০০ স্কয়ার ফিটের খেলার জায়গা আছে। অনূর্ধ্ব-১৪ ও অনূর্ধ্ব-১৭ বয়সভিত্তিক কোচিং এমআইজি ক্রিকেট ক্লাবের বিশেষ সুনাম রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় দু’ঘণ্টার ব্যাচে শিক্ষার্থীরা ক্রিকেটের শিক্ষা নেয়। এখানে বছরব্যাপী ক্রিকেট ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। এছাড়া গ্রীষ্মকালীন ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পেরও সুযোগ রয়েছে এই ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে।
৪। মুলুন্দ জিমখানা
মুলুন্দ জিমখানা একটি পাবলিক ট্রাস্ট একাডেমি। পাবলিক ট্রাস্ট অ্যান্ড সোসাইটি অ্যাক্টের অধীনে ১৯৮৩ সালে এই ক্রিকেট অ্যাকাডেমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অজিনকা রাহানে এই ক্রিকেট অ্যাকাডেমি থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নির্দেশক দ্বারা ক্রিকেট কোচিং করানোর জন্য মুলুন্দ জিমখানা বিখ্যাত। মুলুন্দ জিমখানার প্রাঙ্গণে আধুনিক ক্রিকেট পিচের পাশাপাশি সর্বোচ্চ সুবিধাসম্পন্ন একটি জিম, টার্ফ উইকেট এবং চেঞ্জিং রুম রয়েছে। সিমেন্টের পিচ আর আর্টিফিশিয়াল টার্ফের উপরে অনুশীলন করা হয়। ৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে যে কোনো ক্রিকেট অনুরাগী এখানে ভর্তি হতে পারেন।
৫। ভিসিএ
ভিসিএ মুম্বাইয়ের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। এখানে পিচের প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়া হয়। ৯ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় দেড়শ ছেলে এখানে নিয়মিত ক্রিকেটের শিক্ষা নেয়। খেলোয়াড়দের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে খেলোয়াড়দের এমনকি বিনিময়ে শিক্ষা প্রদান করা হয়। তরুণ অ্যাথলেটদের দক্ষতা যাচাই করার জন্য তারা নিয়মিত ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করে থাকে। প্রতিদিন দুই বেলায় শিক্ষার্থীদেরকে ক্রিকেট বিষয়ে নানা পাঠ দেয়া হয়।
৬। পায়াড়ে ক্রিকেট অ্যাকাডেমি
রঘুবীর সিং ঝালা ও সুরেশ শেঠি নামের দু’জন কোচের অধীনে পায়াড়ে ক্রিকেট অ্যাকাডেমি পরিচালিত হয়। রঘুবীর সিং ঝালা একজন লেভেল বি এর ডিগ্রি নেয়া কোচ। তিনি ১৫ বছর ধরে রঞ্জি পর্যায়ে কোচিং করিয়েছেন। আর সুরেশ শেঠি ১৯৮২-১৯৮৪ মুম্বাইয়ের রঞ্জি দলের হয়ে খেলেছেন। প্রতি বছর জুন থেকে মে মাস পর্যন্ত তাঁরা বাচ্চাদেরকে কোচিং করান। এখানে দুই বেলা শিক্ষার্থীদেরকে ক্রিকেট পাঠ দেয়া হয়।
৭। এসওয়াই ক্রিকেট অ্যাকাডেমি
২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এসওয়াই ক্রিকেট অ্যাকাডেমি অন্যান্য ক্রিকেট অ্যাকাডমির তুলনায় কিছুটা নবীনই বলা চলে। এই অ্যাকাডেমিতে মুম্বাই কিংবা তার বাইরে থেকে অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা ক্রিকেটারেরা ভর্তি হতে পারে। অভাবী শিক্ষার্থীদের জন্য তারা বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা করে। প্রতি ১৫ জন শিক্ষার্থীদের গড়ে একজন শিক্ষকের ব্যবস্থা রয়েছে এই একাডেমিতে।
৮। সঞ্জীবি ক্রিকেট অ্যাকাডেমি
২০১৯ সালের ১৯শে অক্টোবরে সঞ্জীবি ক্রিকেট অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি মূলত মুম্বাইয়ের দক্ষিণ ফোর্ট এলাকাকেন্দ্রিক একটি সংস্থা। মুম্বাই ও পুনের বিভিন্ন এলাকায় তারা কোচিংয়ের সুবিধা দিয়ে থাকে। এখানে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে পারলে শিক্ষার্থীদেরকে ইংল্যান্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। জনাব অরুন কোটিয়ান এই অ্যাকাডেমিটির প্রতিষ্ঠাতা। এর শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে থাকে। এখানে ভিডিও অ্যানালাইসিস ও ফিটনেস ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। শিক্ষার্থীরা নিয়মিতভাবে প্রথম বিভাগ ও জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সাথে কথা বলার সুযোগ পান।
৯। সুনীল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি
পশ্চিম মুম্বাইয়ের চার্চগেট এলাকায় এই সুনীল অ্যাকাডেমির অবস্থান। প্রতিষ্ঠার নাম সুনীল সোনি, নিজে সেখানে প্রধান কোচের ভূমিকা পালন করে থাকেন। এখানে শিক্ষার্থীদেরকে দলগত ও ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয়া হয়। এখানে ইন্ডোর নেট ও বোলিং মেশিনের সুবিধা রয়েছে। অ্যাকাডেমিতে ১-৫ নেটের সুবিধা আছে। অভাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির সুবিধা রয়েছে।
১০। মুম্বাই ইউনাইটেড ক্রিকেট ক্লাব
আদিল কুরেশী ও রাহিল শেখের অধীনে মুম্বাই ইউনাইটেড ক্রিকেট ক্লাব পরিচালিত হয়। এখানে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে কোচিং করানোর সুবিধা রয়েছে। দিনে দু’বার করে ক্লাস করানো হয়। এই ক্রিকেট অ্যাকাডেমিটি উন্নতমানের পিচের জন্য বিখ্যাত।
Cricket Academy in Mumbai মুম্বাইয়ের ক্রিকেটীয় কর্মচাঞ্চল্যের কেন্দ্রে রয়েছে। এসব একাডেমি থেকে প্রতি বছর দারুণ খেলোয়াড় উঠে আসছে।
উপসংহার
ভারত ক্রিকেটের আধুনিক রূপকে বদলে দিয়েছে। জনপ্রিয়তা ও ক্রিকেটারের সংখ্যায় বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের ধারেকাছে নেই কোনো দেশই। মুম্বাইয়ের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিগুলো ক্রিকেট শিক্ষায় ভারতের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। যেসব মাঠে শচীন টেন্ডুলকার, সুনীল গাভাস্কারেরা খেলে বিশ্বসেরাদের কাতারে দাঁড়িয়েছেন, সেই মাঠে নতুন প্রজন্মের তুখোড় ক্রিকেটারদের কলরবে মুখরিত। উন্নতমানের প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধার আয়োজনে দেশের ক্রিকেটের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই অ্যাকাডেমিগুলো। এই শত মাঠের কোনো একটাতে লুকিয়ে আছে ভারতের পরবর্তী বিশ্বজয়ী ক্রিকেটার। দু’বেলা নিবিড় অনুশীলনে সে বিশমঞ্চে পৌঁছোবার সময় গুণছে।