নিগার সুলতানা জ্যোতি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি নিগারের বিশ্বস্ত গ্লাভসজোড়ায় বাংলাদেশ ক্রিকেট আস্থা রাখে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ব্যাটিংশৈলী ও নেতৃত্বগুণ দ্বারা দেশের ক্রিকেটে আলোড়ন ফেলেন নিগার। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই দেশসেরা ক্রিকেটারদের মধ্যে নিজের অবস্থান তৈরি করে ফেলেন তিনি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ক্রিকেটের বিশ্ব দরবারে পৌঁছে গেছে তাঁর নাম,যশ, খ্যাতি। নিগার সুলতানার দেখানো পথে বাংলাদেশে নারী ক্রিকেট নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে। এশিয়া জয়ের পর এখন স্বপ্ন দেখছে ক্রিকেট বিশ্বকাপের।
Nigar Sultana Cricketer এর ক্যারিয়ারের শুরু
নিগার সুলতানা জ্যোতি ১৯৯৭ সালের ১লা আগস্ট বাংলাদেশের শেরপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তাঁর বিশেষ ঝোঁক দেখা হয়। বড়ভাইদের সাথে পাল্লা দিয়ে মাঠে ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু। একসময়ে ক্রিকেটের নেশায় বুঁদ হয়ে উঠলো ছোট্ট জ্যোতি। স্কুলে খেলতো। ঢাকা থেকেও খেলার আমন্ত্রণ এলো। সেই থেকে স্বপ্ন ক্রিকেটার হবেন। কিন্তু সামনে তো বাঁধার পাহাড়। বাংলাদেশে তখন নারী ক্রিকেটে কেবল নড়বড়ে অবস্থা থেকে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। ছোট শহরের মধ্যবিত্ত এক পরিবারের মেয়ের ক্রিকেটার হবার আশাটা স্পর্ধাই বটে।
এমনিতেই রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে, এরপর সামনে দাঁড়িয়ে সমাজ। যেখানে মেয়েদের ক্রিকেট খেলাটাকে ভালো চোখে দেখা হয় না। নিগার সুলতানার ক্রিকেট খেলা দেখে এলাকাবাসী কটুকথা শোনাতো। মেয়েরা ক্রিকেটের পোষাক পড়বে এতেও অনেকের আপত্তি। ক্রিকেটে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়ও দেখিয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু নিগারের পেছনে এসে দাঁড়ালো পরিবার। বাবা-মা নিরন্তর উৎসাহ যুগিয়ে যেতেন। তাঁদের অনুপ্রেরণায় একের পর এক বয়সভিত্তিক দলের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় দলের দোরগোড়ায়। অবশেষে আঠারো বছর বয়সে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দিয়ে “টাইগ্রেস”দের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আঙ্গিনায় পথচলা শুরু জ্যোতির।
Nigar Sultana Cricket এর ক্রিকেট ক্যারিয়ার
২০১৫ সালে অক্টোবর মাসের ৬ তারিখে পাকিস্তানের বিপক্ষেই ওয়ানডে অভিষেক হয়ে নিগার সুলতানার। এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। দলের নতুন সদস্য থেকে মেধার বলে ক্রমেই ব্যাটিংস্তম্ভ হয়ে দাঁড়ালেন শেরপুরের মেয়ে। অফসাইডে সহজাত টাইমিং আর স্ট্রোকমেকিংয়ের মাধ্যমে তিনি দেশের ব্যাটিং অর্ডারে নিজেকে অনন্য করে তুলেছেন। উপরের দিকে দ্রুত উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ধ্বস ঠেকাতে নিগারের জুড়ি নেই। এছাড়া ম্যাচের শেষদিকে বড় শটের মাধ্যমে রান দ্রুত তুলে ফেলতে পারেন। অন্যদিকে উইকেট পেছনের ক্ষিপ্রতার জন্যও বেশ পরিচিতি আছে তাঁর। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে নারী বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারের জন্য নিগার সুলতানাকে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ২০২২ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসের ক্রিকেট কোয়ালিফায়ারের জন্য তাঁকে পুনরায় অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। একই মাসে ২০২২ সালে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ২০২২ নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশ নারী জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত করা হয়।
Nigar Sultana Cricketer এর অর্জন
বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম বড় দু’টি অর্জন নারী ক্রিকেট দলের হাত ধরে এসেছে। পুরুষ ক্রিকেট দল এশিয়া কাপ ক্রিকেটের দোরগোড়া থেকে অশ্রুসিক্ত বিদায় নিয়েছে। অথচ ২০১৮ সালে নিজেদের প্রথম এশিয়া কাপ ফাইনালেই বাজিমাত করে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ভারতের টানা সাত শিরোপার একাধিপত্য হটিয়ে বাংলার নারীরা এশিয়ার সেরা হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। মালয়েশিয়ার সেই স্বপ্নযাত্রার অন্যতম সারথী ছিলেন ২০ বছর বয়সী নিগার সুলতানা জ্যোতি। থাইল্যান্ডের বিপক্ষে টুর্নামেন্টের দশম ম্যাচে জ্যোতির ২৮ বলে ২৫ রানের ইনিংসের পিঠে চেপে নয় উইকেটের জয় পায় বাংলাদেশের অদম্য মেয়েরা। ২০১৮ সালের ১০ই জুন ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংস শেষে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে ১১৩ রানের টার্গেট ছুঁড়ে দেয় ভারতীয়রা। পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়ে জয় ছিনিয়ে নেয় বাংলার বাঘিনীরা। সেই জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই নিগার সুলতানা জ্যোতি। চাপের মুখে তাঁর ২৪ বলে ২৭ রানের লড়াকু ইনিংস বাংলাদেশের জন্য জয়ের ভিত্তি গড়ে দেয়। ফলস্বরূপ এশিয়ার সেরার ট্রফি উঁচিয়ে ধরবার সুযোগ পায় বাংলাদেশ।
পরের বছর এশিয়া কাপেও সেরার স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশের মেয়েরা। নিগার সুলতানা এখানেও দলের সেরা পারফর্মারদের একজন ছিলেন। চার দলের এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল স্বর্ণপদক লাভ করে। এরপর পুরুষ দল স্বর্ণ জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ অনন্য এক “ডবল” অর্জনের কৃতিত্ব লাভ করে। ২০২২ হাংজুতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসেও পদকের পোডিয়ামে ওঠার গৌরব লাভ করে বাংলার বাঘিনীরা। এবার অর্জন করে ব্রোঞ্জ পদক। পোখারায় মালদ্বীপের বিপক্ষে ইতিহাস গড়েন নিগার। নারী ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বপ্রথমে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে শতরানের দেখা পান শেরপুরের সন্তান। কিছুক্ষণ পরে অন্যপ্রান্তে থাকা ফারজানা হকও তিন অংকের দেখা পান। নারী টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে সেই রেকর্ড এখনো অক্ষত রয়েছে। তৃতীয় উইকেট জুটিতে জ্যোতি-ফারজানা তুলেছিলেন ২৩৬ রান। ক্যারিয়ার শুরুর সাত বছরের মধ্যেই গৌরবান্বিত তিনটি মেডেল ঝুলেছে জ্যোতির গলায়। নিগারের নেতৃত্বে বিশ্ব নারী ক্রিকেটে একাধিপত্য বিস্তারকারী অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয় বাঘিনীরা।
Nigar Sultana Cricketer এর ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান
নিগার সুলতানা জ্যোতি এখন পর্যন্ত (১০ই জুলাই, ২০২৪) বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের হয়ে ৪৭টি ওয়ানডেতে অংশ নিয়েছেন। ৪২ ইনিংসে তাঁর সংগ্রহ ৮৯৭ রান। চারবার পঞ্চাশ পেরিয়েছেন, রানের গড় ২৩.৬০। সর্বোচ্চ সংগ্রহ ৭৩ রান। রানের হিসেবে নিগার সুলতানা ওয়ানডে বাংলাদেশী নারী ক্রিকেটারদের তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অবশ্য নিগারের একাধিপত্য। তিনি ৯৫ ম্যাচ খেলে ৯০ ইনিংসে ১৮০২ রান সংগ্রহ করেছেন। ক্যারিয়ারের গড় ২৫.৩৮ যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। সাতটি অর্ধশতক যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একটি শতকও আছে। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহও তাঁর দখলে ১১৩* (৬৫)।
কিপিংয়েও ক্রমাগত নিজের দক্ষতার ছাপ রেখে যাচ্ছেন নিগার। ৪৭টি ওয়ানডে ম্যাচে ৪২টি ডিসমিসালের মালিক তিনি। ২৬টি ক্যাচের পাশাপাশি ১৬টি স্ট্যাম্পিং করেছেন। ভারতের বিপক্ষে এক সিরিজে ২০ ডিসমিসাল নারী ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ। টি-টোয়েন্টিতে ৯৪ ইনিংসে ৮২টি ডিসমিসাল করেছেন ক্ষিপ্র এই উইকেটরক্ষক। যার মধ্যে রয়েছে ৬১টি ক্যাচ ও ২১টি স্ট্যাম্পিং। অভিষেকের পর থেকে এই ফর্মেটে কোনো ম্যাচই মিস দেননি নিগার। টানা ৯৫ ম্যাচ খেলেছেন দেশের হয়ে। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে এক দুর্দান্ত ফিটনেসের চিত্র।
এক নজরে নিগার সুলতানার ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান:
ফর্মেট | ওয়ানডে | টি-টোয়েন্টি |
ম্যাচ | ৪৭ | ৯৫ |
ইনিংস | ৪২ | ৯০ |
অপরাজিত | ৪ | ১৯ |
রান | ৮৯৭ | ১৮০২ |
গড় | ২৩.৬০ | ২৫.৩৮ |
স্ট্রাইক রেট | ৪৯.৬১ | ৮৯.৬৯ |
ফিফটি | ৪ | ৭ |
সেঞ্চুরি | ০ | ১ |
সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ | ৭৩ | ১১৩* |
ক্যাচ | ৪২ | ৬১ |
স্ট্যাম্পিং | ২৬ | ২১ |
উপসংহার
ছোট শহরের মেয়ে জ্যোতি থেমে নেই। নিজের অদম্য ইচ্ছা আর প্রতিভাকে পুঁজি করে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন। লাখো কিশোরী-তরুণীকে ক্রিকেট হবার পথে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণাকে পাথেয় বানিয়ে নিজের স্বপ্নটাকে ছুঁয়ে দেখেছেন। অবশ্য সেখানে থেমে নেই তাঁর আকাশটা। এশিয়া পেরিয়ে এখন বিশ্বসেরার হবার স্বপ্ন দেখছেন। তবে এখনো ক্রিকেট খেলতে বাংলাদেশের মেয়েদের শত বাধা পেরোতে হয় প্রতিনয়ত। সমাজের সাথে চলে লড়াই, লড়াইটা নিজের পরিবারের সাথেও। হয়তো একদিন সেই সময় আসবে। যখন মেয়েদের ক্রিকেট খেলার জন্য আর যুদ্ধ করতে হবে না। নিগার হয়তো থাকবেন না, নতুন কেউ এসে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করবে। বাংলাদেশ জিতবে বিশ্বকাপ।