সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলায় যখন দুই দলের স্কোর মোটামুটি সমান সমান হয়ে যায়, বা বিশ্বকাপের মত বড় টুর্নামেন্টে যখন দুইটি দল একই সংখ্যক ম্যাচে জয়লাভ করে যার কারণে পরবর্তী পর্যায়ে কোন্ দল পৌঁছাবে তা নির্ণয় করা জটিল হয়ে যায়, তখন ‘এনআরআর‘ বা ‘নেট রান রেট‘ তথা নির্দিষ্ট সংখ্যক ওভারে সংগৃহীত রানের গড়ের তুলনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই নেট রান রেট আসলে কী? আর কীভাবেই তা গণনা করা হয়? জানতে হলে আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। নেট রান রেট গণনার প্রক্রিয়ার অনেক বিস্তারিত ও জটিল এবং বাস্তব সম্মত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ রয়েছে, কিন্তু এই আর্টিকেলটিতে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা করা হবে।
নেট রান রেট বলতে কী বুঝায়?
সহজ কথায় সংজ্ঞায়িত করতে গেলে, নেট রান রেট হলো এমন একটি গাণিতিক প্রক্রিয়া যা একজন ব্যাটসম্যানের পার্ফর্ম্যান্স যাচাই করার জন্য ব্যবহার করা হয়। ক্রিকেট পরিসংখ্যানের এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। একটি ম্যাচে প্রথমে ব্যাটিং করতে নামা দলের ওভার প্রতি গড় রান থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করতে নামা দলের ওভার প্রতি গড় রান বিয়োগ করলে নেট রান রেট পাওয়া যায়। অন্যদিকে, বিশ্বকাপ বা কোনো লীগের মত কোনো বড় টুর্নামেন্টে একটি নির্দিষ্ট দলের খেলা প্রতিটি ম্যাচের ওভার প্রতি সংগৃহীত গড় রান থেকে ঐ দলের বিপক্ষে খেলা সবগুলো দলের মোট সংগৃহীত রানের ওভার প্রতি গড় রান বিয়োগ করলে, ঐ দলটির নেট রান রেট পাওয়া যায়।
এনআরআর বা নেট রান রেট যদি ধনাত্মক বা পজিটিভ হয়, তাহলে বুঝতে হবে কোনো দল তার বিপক্ষ দলের চেয়ে সামগ্রিকভাবে দ্রুতগতিতে রান সংগ্রহ করেছে; অন্যদিকে এই গড় ঋণাত্মক বা নেগেটিভ হলে বুঝতে হবে যে সামগ্রিকভাবে বিপক্ষ দলের চেয়ে রান সংগ্রহে সময় বেশি লেগেছে। এই কারণে প্রতিটি দলেরই লক্ষ্য থাকে যেন নেট রান রেট যত বেশি সম্ভব রাখা যায়। তবে এই গড়ের সাথে কোনো দলের মোট সংগৃহীত রান বা একেকটি ম্যাচের গড় রান রেট সাধারণত মিলে না। বিশ্বকাপে ১৯৯২ সালের আসরে প্রথমবারের মত নেট রান রেট ব্যবহার করা হয়। এর আগের আসরগুলোতে টাই-ব্রেকার হিসেবে নেট রান রেট এর পরিবর্তে শুধু রান রেট ব্যবহার করা হতো।
নেতিবাচক দিক ও সমালোচনা
এনআরআর বা নেট রান রেট কিন্তু বেশ সমালোচনারও শিকার। কারণ এই প্রক্রিয়ায় রানের গড় হিসাব করার ক্ষেত্রে উইকেট হারানোর হিসাব গণনায় আনা হয় না। যার কারণে এভাবে রানের গড় হিসাব করে হয়তো একটা জটিল অবস্থায় কোনো টুর্নামেন্টে কে এগিয়ে থাকছে সেই সমস্যার সহজ সমাধান করা যায়, কিন্তু এই বিজয়ের প্রেক্ষিতে দলের সাধারণ গুণাগুন বিচার করা যায় না; মানে, নেট রান রেটের হিসাবে একটি দল অন্যটিকে হারিয়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে এই না যে পরাজয়ী দল, জয়ী দলের চেয়ে খারাপ বা দুর্বল। কাজেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে, এভাবে রান রেটের মাধ্যমে কোনো দলের এগিয়ে থাকাটা বিপক্ষ দলের জন্য খুব দুর্ভাগ্যজনক হয়ে উঠতে পারে।
নেট রান রেট ক্যালকুলেটর বা নির্ণয় প্রক্রিয়া
একক ম্যাচের নেট রান রেট হিসাবের প্রক্রিয়া
ম্যাচের নেট রান রেট = (১ম দলের সংগৃহীত রান/ব্যবহৃত মোট ওভার) – (২য় দলের সংগৃহীত রান/ব্যবহৃত মোট ওভার)
এই সূত্রটিকে একটি কাল্পনিক উদাহরণের সাহায্য়ে ব্য়াখ্যা করছি। কোনো দলের রান রেট বা রানের গড় হিসাব করার জন্য, দলটির সংগৃহীত মোট রানকে ঐ ম্যাচের নির্ধারিত ওভারের- ৫০ ওভার বা ২০ ওভার- পুরোটা বা দলটি যে কয় ওভার ব্যাট করেছে তা দিয়ে ভাগ করা হয়। ধরা যাক কোনো দল ৪৮ ওভার ব্যাট করে ২৭২ রান সংগ্রহ করেছে। তাহলে এই দলের গড় রান হবে ২৭২/৪৮ = ৫.৬৭। এখন ম্যাচটিতে জিততে হলে, অপর দলকে ৫০ ওভারে ২৭৩ রান সংগ্রহ করতে হবে।
আবারো ধরা যাক, এই দ্বিতীয় দলটি ৪৫.৩ ওভার ব্যাট করেই ২৭৩ রান সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে।
এখানে একটি বিষয়ে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন। ৪৫.৩ ওভার মানে ৪৫ ওভার ৩ বল। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায় ঐ ৩ টি বলকে ০.৩ হিসাবে লেখা হয় যা দ্বারা ১০ এর মধ্যে ৩ বুঝায়। কিন্তু ৩ বলের মানে হলো ৬ বলের মধ্যে ৩ টি বল বা এক ওভারের অর্ধেক বা ০.৫। তার অর্থ দাঁড়ালো, এই ২য় ইনিংসে ব্য়াট করতে নামা দলের রানের গড় হবে ২৭৩/(৪৫+৩/৬) = ৬।
এভাবে, এই দুই দলের খেলা ঐ ম্যাচের নেট রান রেট হবে: ২৭২/৪৮ – ২৭৩/(৪৫+৩/৬) = ৫.৬৭ – ৬ = -০.৩৩। যেহেতু এই হিসাবটি ১ম দলকে ভিত্তি করে করা হয়েছে এবং ফলাফল ঋণাত্মক এসেছে, তাহলে এর থেকে বুঝা যায়, ১ম দলটি ম্যাচটি হেরে গিয়েছে। যখন কোনো বড় টুর্নামেন্টে এরকম ঘটে, সেক্ষেত্রে যে দলের এনআরআর যত বেশি হবে সেই দল পয়েন্ট টেবিল বা তালিকায় তত উপরের দিকে থাকবে এবং পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতায় ততই এগিয়ে থাকবে। এই প্রক্রিয়াটি সহজে হিসাব করার জন্য অনেক অনলাইন ক্যালকুলেটর রয়েছে, আগ্রহী হয়ে থাকলে এখানে চেক করে দেখতে পারেন।
ম্যাচ চলাকালে মাঠে ব্যবহৃত স্কোরবোর্ড
টুর্নামেন্টের নেট রান রেট হিসাব করার প্রক্রিয়া
আগেই বলেছি, যে কোনো লীগে বা বড় টুর্নামেন্টের কোনো গ্রুপের তিন বা ততোধিক দলের মধ্যে কোনো একটি দলের নেট রান রেট বা রানের গড় দলটির সবগুলো ম্যাচের গড় রানের সমান হবে না, বরং সবগুলো ম্যাচে সংগৃহীত মোট রানকে সবগুলো ম্যাচে ব্যবহার করা মোট ওভার দিয়ে ভাগ করে যে গড় পাওয়া যাবে সেটা থেকে, ঐ দলের বিপক্ষে খেলা সবগুলো দলের করা মোট সংগৃহীত রানকে ঐ দলটির বল করা মোট ওভারের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে যে গড় পাওয়া যাবে, তা বিয়োগ করে ঐ দলটির নেট রান রেট হিসাব করা হয়। এই প্রক্রিয়ার সূত্রটি হবে এরকম:
দলের নেট রান রেট = (দলের সংগৃহীত মোট রান/ব্যবহৃত মোট ওভার) – (বিপক্ষ দল সমূহের সংশ্লিষ্ট দলের বিরুদ্ধে সংগৃহীত মোট রান/ব্যবহৃত মোট ওভার)
সাধারণ নিয়মের কিছু ব্যতিক্রম
১. যদি কোনো দল ৫০ ওভারের মধ্যে সবগুলো উইকেট হারায়, তাহলে ঐ দলের নেট রান রেট হিসাব করার সময়ে পুরো ৫০ ওভারই গণনায় ধরা হয়। যেমন উপরের উদাহরণে ২য় দলটি ৪৫.৩ ওভার ব্যাট করে যদি সবগুলি উইকেট হারাতো তাহলে গড় হিসাব করার সময়ে ২৭৩/(৪৫+৩/৬) এর পরিবর্তে, ২৭৩/৫০ ধরে হিসাব করা হতো। তাহলে গড় দাঁড়াতো ৫.৪৬। সেক্ষেত্রে কিন্তু ২য় দলটি পরাজয়ী হিসেবে গণ্য হতো। আর একারণেই নেট রান রেটকে সঠিক বলে মেনে নিতে অনেকেরই আপত্তি থাকে।
২. যদি কোনো ম্যাচ কোনো কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয় যেমন বৃষ্টির কারণে, তখন ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যেখানে একটি নতুন সংশোধিত লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে, এই সংশোধিত লক্ষ্য ও নির্দিষ্ট পরিমাণ ওভার ১ম দলের ইনিংসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। আর ২য় দলের স্বাভাবিকভাবে সংগৃহীত রান ও ব্যবহৃত ওভারকে বিবেচনায় রাখা হয়। ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি যে তেমন একটা জনপ্রিয় নয়, তা বলাই বাহুল্য।
একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের পয়েন্টস্ টেবিল
৩. ফলাফল নেই বলে পরিত্যক্ত এমন ম্যাচের ক্ষেত্রে ঐ ম্যাচের কোনো দলেরই কোনো রান বা বোল করা ওভার গণনায় ধরা হয় না।
৪. ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ার পরেও যদি ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো ফলাফল পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে নেট রান রেট গণনার জন্য উভয় দলের দ্বারা ব্যবহৃত ওভারের সংখ্যা বলতে আসলে ২য় ইনিংসে ব্যাট করতে নামা দলের ব্যবহৃত ওভারের সংখ্যাকে বুঝানো হয়। ১ম দলের জন্য, ২য় দলের সমতুল্য স্কোর বিবেচনায় নেওয়া হয়, অর্থাত্ ১ম দলের সমতুল্য রান সংগ্রহ করতে হলে, যে কয়টি ওভার নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে সেই কয়টি ওভারে ২য় দলকে যত রান সংগ্রহ করতে হতো সেটাই এই পদ্ধতিতে ১ম দলের স্কোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর ২য় দলের স্বাভাবিক স্কোরটিই বিবেচনায় রাখা হয়।
বিষয়টি বেশ জটিল, তাই না? একারণেই এই পদ্ধতিগুলো বেশ সমালোচিত। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের জন্য এগুলো ততটা জটিল নয়। তাছাড়া এই হিসাবগুলো তো আর খাতা-কলম নিয়ে অংক কষে বের করা হয় না, প্রযুক্তির কল্যাণে এখন মানুষের জন্য কম্প্যুটারই এসকল হিসাব করে থাকে। একেকটি ক্রিকেট ম্যাচে যে পরিমাণ বিশ্লেষণ, পরিসংখ্যান, তুলনা, গড় রান, নেট রান রেট, বলের গতি, ছক্কার দূরত্ব ইত্যাদি গাণিতিক হিসাব করা হয়, প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার ছাড়া এগুলো এখন সম্ভব বলে মনেই হয় না, অন্তত ম্যাচ চলা অবস্থায় তা নয়-ই!