যারা নিয়মিতভাবে ক্রিকেট খেলা দেখে থাকেন তারা সকলেই জানেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়াম বিশ্বের অন্যতম একটি ক্রিকেট ভেন্যু, যদিও দেশটিতে আরও উন্নত স্টেডিয়ামও রয়েছে। অনেকেই হয়তো এটাও জানেন যে ২০০৫ সাল থেকে ইন্টারন্য়াশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)-র প্রধান কার্যালয়ও একই দেশের দুবাই-এ স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু এই সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) জাতীয় ক্রিকেট দল সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?
এমিরেটস্ ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি), ১৯৮৯ সালে আইসিসি‘র অ্যাফিলিয়েট মেম্বার হয় এবং ১৯৯০ সালে অ্যাসোসিয়েট মেম্বার বা সহযোগি সদস্য পদ লাভ করে। ইউএই-তে নারী ও পুরুষ উভয়েরই পৃথক পৃথক জাতীয় দলও রয়েছে। সর্বশেষ, ২০১৫ সালের একদিনের এবং ২০২২ সালের টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপেও দেশটি অংশগ্রহণ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইউএই দলের উপস্থিতি যথেষ্ট নয় বলেই হয়তো এই দলটি সম্পর্কে ক্রিকেট অনুরাগীদের আগ্রহ ও জানাশোনাও তুলনামূলক কম। ইউএই পুরুষদের জাতীয় ক্রিকেট দল সম্পর্কে আলোচনা থাকছে এই আর্টিকেলটিতে।
ইউএই জাতীয় ক্রিকেট দল: সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৮৯২ সালে বর্তমানের সংযুক্ত আরব আমিরাত ‘ট্রুসিয়াল রাষ্ট্র‘ হিসেবে পরিচিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই দেশের সর্বত্র ক্রিকেট খেলা ছড়িয়ে পরতে শুরু করে কারণ, সেই সময়ে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্স এবং কমনওয়েল্থ এর অন্যান্য সামরিক দলের বিভিন্ন পেশাদার ব্য়ক্তি- যাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যাণ্ড-এর প্রথম শ্রেণীর ও বিভিন্ন ক্লাবের খেলোয়াড়েরাও ছিল- আজমান, আলা আঈন, দুবাই ও শারজাহ সহ বিভিন্ন শহরে নিয়োজিত ছিল এবং অবসর সময়ে নিজেদের প্রিয় খেলা ক্রিকেট খেলে সময় কাটাতো। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে, শারজাহ‘র বিমান ঘাঁটির নিকটে তাদের তৈরি পিচ, ব্রিটিশ ও অন্যান্য বিদেশি দলের খেলোয়াড়েরা ব্যবহার করতো।
এরপরে আয়োজিত হতে শুরু হয় দেশটির বিভিন্ন শহরের গড়ে ওঠা দলের মধ্যে ঘরোয়াভাবে ক্রিকেট প্রতিযোগিতা যেমন দুবাই স্টেডিয়ামে, দুবাই ও শারজাহ‘র অধিবাসিদের মধ্যে চলতে থাকে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলা। আল আঈন-এর গার্ডেন সিটি-তে রয়েছে ইউএই‘র সবচেয়ে পুরনো ক্রিকেট কাউন্সিল। কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে জনপ্রিয়তা পাওয়া এই খেলাটির জনপ্রিয়তা, ১৯৭১ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভের পরে অনেকটাই হারিয়ে যায়।
তবে ক্রিকেটের তীর্থস্থান নামে লোকপ্রিয় দক্ষিণ এশিয়া-র অধিবাসিরা যখন এই দেশে অভিবাসী হিসেবে বসবাস করতে শুরু করে, তখন নিজেদের ক্রিকেট প্রেমকে শুধু যে এই দেশে সাথে করে নিয়ে আসে তা-ই নয়, রীতিমত পুনরুজ্জীবিত করে। সেই সাথে ভারত ও পাকিস্তান থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে দেশে ফিরে আসা স্থানীয়রা, ইউএই-তে ক্রিকেট ক্লাব গড়ে তুলতে শুরু করে। ফলস্বরূপ, ১৯৮০‘র দশকে এখানে নিয়মিতভাবে ঘরোয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজিত হওয়া শুরু হয়।
ইউএই জাতীয় ক্রিকেট দলের বিভিন্ন পর্যায়
এমিরেটস্ ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) প্রতিষ্ঠা
সংযুক্ত আরব আমিরাত জাতীয় ক্রিকেট দল প্রতিষ্ঠার পরে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইন্স এর বিপক্ষে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক দলের বপক্ষে ক্রিকেট ম্যাচে অংশগ্রহণ করে যা শারজাহ-তে আয়োজিত হয়, কিন্তু বৃষ্টির কারণে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়, যদিও পাকিস্তানের ঐ দলটির বিশাল স্কোরের জবাবে ব্যাট হাতে ইউএই-র অবস্থা খুব দ্রুতই নাজেহাল হয়ে পরে।
এরপরে, বিত্তশালী স্থানীয় অধিবাসিরা এই খেলায় অর্থ বিনিয়োগ করতে শুরু করলে ‘শারজাহ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়াম‘ নামে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মিত হয়। ১৯৮৪ সালে এই স্টেডিয়ামের প্রথম আন্তর্জাতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয় যা ছিল ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ। এখনো পর্যন্ত এই স্টেডিয়ামে ২৪৪ টি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হয়েছে।
অবশেষে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এমিরেটস্ ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। কিন্তু পরের বছরই জাতীয় দল, হল্যাণ্ড-র কাছে দুইবার খুব বাজেভাবে হেরে যাওয়ার পরে কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে, দলটি থেকে প্রত্যাশিত ফল লাভ করতে হলে এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। কারণ এরপরই ছিল ১৯৯৪ সালর আইসিসি ট্রফি যেখানে সফল পার্ফর্ম্যান্সের পরেই সম্ভব হবে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ এবং তারপরে আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন। সেই উদ্দ্যেশ্য সফল করার জন্য বোর্ড যে নীতি অবলম্বন করে তা ঘিরে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফি বিতর্ক
১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যাট হাতে ইউএই‘র এস হুসেন
১৯৯৪ সালের আয়োজিত আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য ইসিবি, ক্রিকেটীয় স্বচ্ছতার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ অস্বচ্ছ একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে। বোর্ডটি, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বেশ কয়েকজন নাগরিককে ইউএই-তে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে তাদেরকে দেশটিতে স্থায়ী নাগরিক হিসেবে অবস্থানের আহ্বান জানায়। বিনিময়ে এই খেলোয়াড়দের ইউএই-র জাতীয় দলে খেলতে হবে। এভাবে তৈরি হওয়া জাতীয় দলে সুলতান জারাওয়ানী নামে মাত্র একজন আরব নাগরিক ছিলেন যার নেতৃত্বে দলটি আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করে।
১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে, কেনিয়া-কে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয় ইউএই জাতীয় ক্রিকেট দল। এর ফলে ১৯৯৬ সালের একদিনের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে দলটি। কেনিয়ার ক্রিকেট বোর্ড ও খেলোয়াড়েরা এই ম্যাচের পরাজয়ের পরে স্বভাবতই ভীষণ ক্ষেপে যায় এবং তারা সহ অন্যান্য আরও অনেক ক্রিকেট বোদ্ধাও মনে করেন যে ইউএই-র এই জাতীয় ক্রিকেট দলটি, বিদেশ থেকে আমদানি করা ‘ভাড়াটে খেলোয়াড়‘ দিয়ে তৈরি। আইসিসি ঠিক সেই সময়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও, এরপর থেকে আইসিসি অনুমোদিত সকল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের যোগ্যতা আরও কড়াকড়ি করে দেওয়া হয়।
ইউএই জাতীয় ক্রিকেট দলের বর্তমানের চিত্র
প্রথম ২০ বছর: আইসিসি টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৪
১৯৯৪ সালে ইউএই জাতীয় দল, ভারত ও পাকিস্তান-এর বিপক্ষে অস্ট্রাল-এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করে যা ছিল এই দলটির খেলা প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। একই বছরে তারা কেনিয়া ও হল্যাণ্ডের সাথে খেলা ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। এরপরের বছরে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। এরপরেই ছিল ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ যেখানে ইউএই জাতীয় ক্রিকেট দল হল্যাণ্ডের বিপক্ষে খেলা একটি ম্যাচ ছাড়া সবগুলো ম্যাচেই পরাজিত হয়।
১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণের শর্তাবলী, আগের চেয়ে কড়াকড়ি ছিল। এই টুর্নামেন্টে ইউএই, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কাছে পরাজিত হলে ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপে অংশগ্রহণে ব্য়র্থ হয়। ইউএই জাতীয় ক্রিকেট দল এরপরে বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে এবং ওমান-কে পরাজিত করে ২০০৪ সালের এসিসি কাপে বিজয়ী হয়। আর ঐ বছরেই দলটি এশিয়া কাপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রত্যাবর্তন করে। দলটি নিয়মিতভাবে এসিসি ট্রফি, ইন্টারকন্টিনেন্টাল ট্রফি ও আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরাজিত হয়।
২০১০ সালের অক্টোবর মাসে, আফগানিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন কোচ, কবির খান-কে ইউএই দলের কোচ হিসেবে নিয়োজিত করা হয়। কবির খানের অধীনে আফগানিস্তান একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জনে সফল হয়। ইউএই দলে যোগ দেওয়ার সময়ে তার লক্ষ্য ছিল দলটিকে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিতব্য আইসিসি টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপ-এ খেলার যোগ্যতা অর্জনে সমর্থ করা।
নব-নিযুক্ত কোচ ও দলের প্রত্যাশিত সফলতা পেরে আরও কিছুটা সময় লাগে। ২০১৩ সালের টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার টুর্নামেন্টে ইউএই জাতীয় ক্রিকেট দল চতুর্থ স্থান লাভ করে এবং কোয়ার্টার ফাইনালে হল্যাণ্ডকে হারিয়ে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপ-এ অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করে।
আইসিসি ওডিআই বিশ্বকাপ ২০১৫
২০১৪ সালের টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপে, ইউএই জাতীয় দলের সফরটিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। টুর্নামেন্টটিতে দলটি সকল ম্যাচেই পরাজিত হয়। তবে আশার খবর এই ছিল যে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যাণ্ড-এ ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিতব্য একদিনের বিশ্বকাপ আসরে তারা অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করে। প্রায় ২০ বছর পরে এই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী ইউএই জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়েরা বেশিরভাগই যথার্থরূপে পেশাদার ক্রিকেটার ছিলেন না।
নিউ জিল্যাণ্ডের নেলসন-এ অনুষ্ঠিত ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পুল বি-র গ্রুপ পর্যায়ের একটি ম্যাচে জিম্বাবুই-র বিপক্ষে, ইউএই ঐ সময় পর্যন্ত একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে দলগত সর্ব্বোচ্চ রান সংগ্রহ করে। কিন্তু ৬ টি ম্যাচের প্রতিটিতেই পরাজিত হয়ে তারা বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। তবে ব্রিসবেনে, আয়ারল্যাণ্ড-র বিপক্ষে খেলা ম্যাচটিতে ইউএই দলের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে শতরানের কৃতিত্ব অর্জন করেন শায়মান আনোয়ার।
প্রথম বিশ্বকাপ শতরানের পথে ইউএই জাতীয় দলের শায়মান আনোয়ার
সর্বশেষ পরিস্থিতি
২০২২ সালে অনুষ্ঠিত টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ইউএই জাতীয় দল অংশগ্রহণ করে এবং শুধুমাত্র নামিবিয়া-র বিপক্ষে খেলা ম্যাচটিতেই জয়লাভ করে। ২০২৩ সালে ইউএই জাতীয় দল, ৩ টি আন্তর্জাতিক টিটোয়েন্টি ম্যাচ খেলার জন্য নিউ জিল্যাণ্ড সফরে যায়। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে ২য় ম্যাচে তারা ৭ উইকেটে নিউ জিল্যাণ্ড জাতীয় দলকে পরাজিত করে।
এখনো পর্যন্ত ইউএই জাতীয় দলের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে, একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্ব্বোচ্চ সংখ্যক শতরানের অধিকারীরা হলেন আসিফ খান (৩ টি, সর্ব্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১৫১ নট আউট), রমিজ শাহজাদ (২ টি, সর্ব্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১২১ নট আউট), চিরাগ সুরি (২ টি, সর্ব্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১১৫) এবং ভি অরবিন্দ (২ টি, সর্ব্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১১৫ নট আউট)।
উত্থান-পত্তনে ভরপুর ইউএই জাতীয় ক্রিকেট দলের ইতিহাস থেকে শুরু করে সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তারা চেষ্টা করা বন্ধ করেনি। বারবার পরাজিত হয়েও তারা লড়াই করার জন্য নতুন করে প্রস্তুতি নিয়ে ফিরে এসেছে। আর আমরা খুব ভালভাবেই জানি অধ্যবসায়ের একমাত্র ফল, সাফল্য।