পাওয়ারপ্লে আধুনিক ক্রিকেটের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। ব্যাট আর বলের লড়াইকে সীমিত ওভারে আরো চমকপ্রদভাবে উপস্থাপন করতে এর উদ্ভব। দলের ওপেনারেরা এই সময় যেমন স্বভাবত বিগ হিট করে দলকে এগিয়ে রাখতে চায়, তেমনি পেস বোলারেরা নতুন বলের সুইং ও শাইনকে কাজে লাগিয়ে নিজের অধিনায়ককে উইকেট এনে দিতে চায়। সাদা বলের সীমিত ওভারের ক্রিকেটকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পাওয়ারপ্লে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। এই সময়টুকুতে ম্যাচের লাগাম হাতে তুলে নিতে বোলার আর ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তুমুল লড়াই চলে। মাঠে দর্শকের উৎসবের হিল্লোল ওঠে, আবার টিভির সামনে বসে থাকা ভক্তের চোখ চুম্বকের মতন লেগে থাকে পর্দায়। ক্রিকেটের আবেদন বাড়িয়ে দিয়েছে, বাইশ গজের লড়াইটাকে করেছে আরো চিত্তাকর্ষক।
Powerplay এর ইতিহাস
ক্রিকেটে পাওয়ারপ্লে এর ধারণাটা আসে কেরি প্যাকারের সত্তরের দশকের ওয়ার্ল্ড সিরিজ থেকে। এরপর আশির দশকে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ওয়ানডে ক্রিকেটে পাওয়ারপ্লে চালু করা হয়। তখন প্রথম দশ ওভারে সর্বোচ্চ দু’জন ফিল্ডার তিরিশ গজের বাইরে অবস্থান করতে পারতো। এরপর বাকি চল্লিশ ওভারে সেই সংখ্যাটা দাঁড়াতো সর্বোচ্চ পাঁচজন। ১৯৯২ সালে আইসিসি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্রিকেটে পাওয়ারপ্লের সূচনা করে। তখন প্রথম পনের ওভার ছিল বাধ্যতামূলক “ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন”। ফিল্ডিং সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে তখন সীমিত ওভারের খেলায় শুরুর দিকে মারকুটে ব্যাটিং এর চল শুরু হয়। এটাকে “পিঞ্চ হিটিং” বলা হতো। তখন নিউজিল্যান্ডের মার্ক গ্রেটব্যাচ, শ্রীলংকার সনাথ জয়াসুরিয়া, রমেশ কালুভিতারানা, অস্ট্রেলিয়ার গ্রেগ ব্লিওয়েট প্রমুখ পিঞ্চ হিটার হিসেবে পরিচিতি পান। সাদা বলের ক্রিকেটে এই আনন্দদায়ক ও রোমাঞ্চজাগানিয়া ব্যাটিং বিশ্বব্যাপী ওয়ানডে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা রাতারাতি বাড়িয়ে দেয়। ২০০৫ সাল থেকে আইসিসি এর পাওয়ারপ্লে এর নিয়ম পরিবর্তন করে। তখন দশ ওভারের বাধ্যতামূলক পাওয়ারপ্লে এর পরে আরো পাঁচ ওভারের দু’টি পাওয়ারপ্লে চালু করা হয়। ১১-৪০ ওভারের মধ্যে ব্যাটিং দল একবার ও বোলিং দল একবার করে এই পাওয়ারপ্লে নিতে পারতো। এরপর ২০১২ সাল থেকে পাওয়ারপ্লে এর নিয়ম পুনরায় বদল করা হয়। বর্তমানে ওয়ানডে ক্রিকেটে পাওয়ারপ্লে হয় তিনটি ধাপে। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হওয়া টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে শুরু থেকেই পাওয়ারপ্লে আছে।
Powerplay এর বর্তমান নিয়ম
২০১২ সাল থেকে চলে আসা ওয়ানডে ক্রিকেটে পাওয়ারপ্লে এর নিয়ম বর্তমানে অপরিবর্তিত রয়েছে। এখন এই পাওয়ারপ্লেকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম দশ ওভারে ৩০ গজের বাইরে ফিল্ডিং দলের মাত্র দু’জন ফিল্ডার দাঁড়াতে পারবে। এই সময়ে ব্যাটিং দল চেষ্টা করে যথাসম্ভব বাউন্ডারি মেরে দলের রানের গতিকে এগিয়ে নিতে। ফিল্ডিং দলের অধিনায়ক সাধারণত নিজের পেস বোলারদের গতি ও সুইং এর ওপর ভরসা করেন। কিছু স্পিন বোলার আছেন যারা স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে পাওয়ারপ্লেতে বল করার দুঃসাহস দেখান। এরপর ১১-৪০ ওভারে দ্বিতীয় পাওয়ারপ্লে নেয়া হয়। এই সময়ে সাধারণত স্পিন বোলারদেরকে আক্রমণে আনা হয়। সর্বশেষে ৪১-৫০ ওভার হলো তৃতীয় পাওয়ারপ্লে এর সময়কাল। এই সময়ে স্কোর বাড়িয়ে নেবার জন্য ব্যাটিং দল আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলে। অপরদিকে বোলিং দলের “ডেথ ওভার স্পেশালিস্ট” বোলারেরা নিজের গতির অদল-বদল ও বোলিংয়ে তারতম্য দেখিয়ে উইকেট তুলে নেবার চেষ্টা করেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে শুরু থেকেই পাওয়ারপ্লে এর নিয়ম অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রথম ছয় ওভারে দু’জন ফিল্ডার ৩০ গজের বাইরে সীমানায় দাঁড়াতে পারবে। পরের ১৪ ওভার এই সংখ্যাটা বেঁড়ে দাঁড়াবে পাঁচে।
Powerplay এ সেরা ব্যাটসম্যানেরা
পাওয়ারপ্লে সাদা বলের ক্রিকেটের খোলনলচে পালটে দেয়া এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। এর ফলে খেলার শুরুতেই দর্শকেরা স্ট্রোকের ফুলঝুড়ি দেখার সুযোগ পায়। “ইউনিভার্স বস” খ্যাত জ্যামাইকান ওপেনিং ব্যাটসম্যান ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল এই পাওয়ারপ্লে এর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। টেস্ট ক্রিকেটে ট্রিপল সেঞ্চুরি থাকা সত্ত্বেও এই ক্যারিবীয় ক্রিকেট ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন সীমিত ওভার ক্রিকেটে তাঁর দানবীয় ব্যাটিংশৈলীর জন্যই। ভারতের “হিটম্যান” খ্যাত রোহিত শর্মা পাওয়ারপ্লেতে ব্যাটকে তলোয়ার বানিয়ে রীতিমত বোলারদেরকে শাসন করেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনটি ডাবল সেঞ্চুরির মালিক রোহিতের গ্যালারিতে আছড়ে পড়া পুল শট আধুনিক ক্রিকেটের এক নান্দনিক দৃশ্য। রোহিতের পূর্বসূরি বীরেন্দর শেবাগ ছিলেন ক্রিকেটের সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাটারদের একজন। দিল্লীর ছেলে “বীরু” এর কব্জির জোরের কাছে নত ছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্ব।
দক্ষিণ আফ্রিকায় নব্বইয়ের দশকে হার্শেল গিবস পাওয়ারপ্লেতে মারমুখী খেলতেন, এই প্রজন্মে প্রোটিয়াদের হয়ে একই ভূমিকা পালন করেন কুইন্টন ডি কক। ইংল্যান্ডের জশ বাটলার তাঁর উইলোর নৈপুণ্যের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আধুনিক ক্রিকেটে উইকেটরক্ষকদের সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছেন তাঁর মারমুখী ব্যাটিং এর মাধ্যমে। একুশ শতকে অজিদের হয়ে একই কাজ করেছেন ক্রিস গেইল। নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম আইপিএল অভিষেকে ইতিহাস রচনা করেছিলেন সেঞ্চুরি দিয়ে। পাওয়ারপ্লেতে নিয়মিতই বাউন্ডারির পসরা বসিয়ে “ব্ল্যাকক্যাপ”দেরকে ম্যাচে এগিয়ে দিতেন কিউই ওপেনার।
Powerplay এর সেরা বোলারেরা
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আধিপত্যের যুগে বোলারদের আধিপত্য খর্ব হয়েছে বলে মনে করেন বহু ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ। তবু অনেক বোলার এত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও নিজেদের জাত চেনাতে ভুল করেননি। পাওয়ারপ্লেতে সেরা বোলারদের তালিকা করলে নিঃসন্দেহে সেখানে যশপ্রীত বুমরাহ এর নাম থাকবে। স্বল্প রান-আপ নিয়ে আসা গুজরাটি বোলারেরা একেকটা ডেলিভারি যেন ব্যাটসম্যানের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুফাঁদ। বুমরাহ যেন চাইলেই ওভারের প্রতি বলে ইয়র্কার মেরে ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প ছত্রখান করে দিতে পারেন। অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তী গ্লেন ম্যাকগ্রা তাঁর আঁটসাঁট লাইন-লেন্থের ফাঁসে ব্যাটসম্যানদেরকে আটকে ফেলতেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলার শন পোলক একইভাবে পাওয়ারপ্লে ওভারে তাঁর কার্যকারিতা দেখিয়েছেন। ভারতের সুইংয়ের জাদুকর ভুবনেশ্বর তাঁর সুইংয়ের মায়াজালে বহু ব্যাটসম্যানকে আটকেছেন। কিউই পেসার ট্রেন্ট বোল্ট একইভাবে তাঁর ইনসুইং ডেলিভারিতে অনেক উইকেট শিকার করেছেন। আধুনিক যুগে বিলুপ্ত হতে বসা জাত পেস বোলারদের মধ্যে ডেইল স্টেইনকে পাওয়ারপ্লেতে নিয়মিত রুদ্রমূর্তিতে দেখা গেছে।
Powerplay এর সময়ে ব্যবহৃত কৌশল
সীমিত ওভারের ক্রিকেট ম্যাচ কোনদিকে মোড় নিবে, সেটি নির্ধারণ করে দেয়ার ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে এই পাওয়ারপ্লে। ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম দশ ওভারে রানরেট বাড়িয়ে নেয়ার জন্য ব্যাটসম্যানদেরকে শট খেলতে দেখা যায়। তারা প্রায়ই কাভার ড্রাইভ, পুল শট কিংবা ফ্লিকের মাধ্যমে বাউন্ডারির দিকে বল পাঠানোর চেষ্টা করে। অনেকে বোলারদেরকে নড়বড়ে করে দেবার জন্য ডাউন দ্য উইকেটে এসে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে শট মারার চেষ্টা করে। উইকেটের পেছনে ফিল্ডার না থাকায় আচমকা ব্যাটের কানায় লেগে এই অঞ্চল থেকে প্রচুর রান আসে।
অন্যদিকে বোলারেরাও নতুন বলের সম্পূর্ণ ফায়দা তুলে নেবার চেষ্টা করে। বর্তমানে দু’প্রান্ত থেকে একটি করে নতুন বল দিয়ে খেলা হয়। এর ফলে পাওয়ারপ্লেতে বল শক্ত ও চকচকে থাকে। কন্ডিশন ও উইকেট বুঝে বোলারেরা এই সময়ে সুইং আদায়ের চেষ্টা করেন। নতুন বলে শর্ট বল ও বাউন্সারও তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। অফস্ট্যাম্পের বাইরে পঞ্চম স্ট্যাম্পের লাইনে বল করা নিরাপদ বলে গণ্য করা হয়। বোলারেরা সাধারণত ব্যাটসম্যানদেরকে কোনো বাড়িতে জায়গা দিতে চায় না। তাই অনেককে উইকেট টু উইকেট বল করতেও দেখা যায়। অনেক বোলার আবার প্রতিপক্ষকে চমকে দেবার জন্য বলের গতির তারতম্য দেখান। অনেক ব্যাটসম্যান আবার স্কুপসহ নানা ধরণের অভিনব শট খেলেন দ্রুত রান তোলার জন্য। বর্তমানে ব্যাটিং দলের জন্য পাওয়ারপ্লে এর ওভার শেষে টি-টোয়েন্টিতে পঞ্চাশ রান এবং ওয়ানডেতে সত্তর রানকে ভালো স্কোর হিসেবে গণ্য করা হয়।
উপসংহার
পাওয়ারপ্লেকে বর্তমানে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ম্যাচের দিকবদল করে দেয়ার মূল হাতিয়ার বলে মনে করা হয়। একজন কুশলী বোলার যেমন এই সময়ে দু’টো উইকেট কিংবা পাঁচটা ডট বলের মাধ্যমে নিজের দলকে এগিয়ে নিয়ে যান, তেমনি একজন মারকুটে ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং তাণ্ডবে প্রতিপক্ষের আক্রমণ দিশেহারা হয়ে যেতে পারে। পাওয়ারপ্লেতে বল করার জন্য অধিনায়ক নিজের সবচেয়ে সেরা বোলারদেরকে বেছে নেন। ব্যাটিং দল পাওয়ারপ্লেতে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য স্ট্রোকমেকারদেরকে ব্যাটিংয়ে পাঠায়। আধুনিক ক্রিকেটে পাওয়ারপ্লে এক রোমাঞ্চের নাম, দাবার ছকের মতন যেখানে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণে মাতে বিশ্বসেরা ক্রিকেটারেরা।