ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার পৌঁছে গেছে হিমালয়ের পাদদেশেও। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মত নেপালেও ক্রিকেট এখন জনপ্রিয়তার তুংগে। দীপেন্দ্র সিং আইরি, করণ কেসি, সন্দ্বীপ লামিচানেরা এখন দেশের একেকজন ক্রিকেটীয় নায়ক। বড় টুর্নামেন্টে এখন নেপালিরা চমক দেখাতে শুরু করেছে। ১৯৯৬ সালে আইসিসির সহযোগী সদস্যপদের মর্যাদা লাভ করার পর ক্রিকেটে আগ্রহ বাড়তে থাকে নেপালিদের। এখন তারা এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের নিয়মিত সদস্য।
Nepal National Cricket Team ইতিহাস
উনিশ শতকের শেষের দিকে নেপালে ক্রিকেটের প্রচলন শুরু হয়। শুরুতে খেলার গণ্ডি ছিল সীমাবদ্ধ। তখন নেপালের শাসক রানা পরিবার ও সমাজের অভিজাতেরা এই খেলায় অংশ নিতেন। এরপর ১৯৪৬ সালে নেপাল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খেলাটি অভিজাত সমাজে দ্রুত ছড়াতে শুরু করে। ১৯৫১ সালের বিপ্লবের পর থেকে ক্রিকেট সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়াতে শুরু করে। ১৯৬১ সালে জাতীয় স্পোর্টস কাউন্সিল যোগ দেয় নেপাল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। তবে আশির দশক পর্যন্ত খেলা শুধু কাঠমুণ্ডু উপত্যকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখন এলাকাভিত্তিক ক্রিকেট খেলা হতো। তবে এর বাইরে অন্য শহর অথবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্রিকেট খেলার প্রচলন ছিল না।
Nepal National Cricket Team আইসিসির সদস্যপদ লাভ
আশির দশকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের সাথে সাথে কাঠমুণ্ডুর বাইরে ক্রমাগত ছড়াতে শুরু করে ক্রিকেট। দেশটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের সংশ্লিষ্ট সদস্যের মর্যাদা লাভ করে ১৯৮৮ সালে। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে দেশের ক্রিকেটের পটভূমি দ্রুত বদলে যেতে শুরু করে। ক্রিকেট নেপালিদের কাছে হয়ে ওঠে নতুন আকর্ষণ। এই সময়ে অঞ্চলভিত্তিক ও জেলাভিত্তিক টুর্নামেন্টের প্রচলন শুরু হয়। স্কুলগুলোতে নিয়মিতভাবে ক্রিকেট খেলা শুরু হয়।
এরপর ক্রিকেট আগ্রহের তুঙ্গে পৌঁছে যায়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে দলের সংখ্যা কমিয়ে দিতে হয় টুর্নামেন্ট খেলার আগে। কারণ সেই সময়ে এতগুলো দল একসাথে খেলার অবকাঠামো ছিল না নেপালে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দুই তারিখে নেপাল আইসিসির সহযোগী সদস্য হবার সুযোগ পায়। ঐ বছরেই কুয়ালালামপুরে এসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করে তারা।
১৯৯৮ সাল মধ্যে নেপালে অবকাঠামোগত প্রচুর উন্নতি সাধিত হয়। এরপর আইসিসি সেখানে এসিসি ট্রফির আয়োজন করে। ললিতপুর ও কীর্তিপুরের দুটি মাঠে এই টুর্নামেন্টের খেলাগুলো আয়োজিত হয়। বর্তমানে সহযোগী সদস্যের মধ্যে এই দেশটিতে ক্রিকেট জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ২০১৬ সালে আইসিসি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ নেপালকে নিষেধাজ্ঞা দেয়, অতিরিক্ত সরকারি হস্তক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্ত আসে। এরপর তিন বছর পর ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে সংস্থাটির সদস্যপদ পুনর্বহাল করা হয়।
Nepal National Cricket Team একুশ শতকের পরিস্থিতি
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে নেপালের বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ২০০০ সালের শুরুতে এসে এর উপকারিতা পায় নেপালের ক্রিকেট দল। সেই বছরে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপে অষ্টম স্থান অধিকার করে নেপাল। নেপালের এই অর্জন তাদের ক্রিকেটে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এরপর সিনিয়র দলও তাদের ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করে। শারজাতে অনুষ্ঠিত ২০০০ এসিসি ট্রফিতে নেপাল সেমিফাইনালে পৌঁছে। সেখানে হংকংয়ের কাছে পরাজিত হলেও সেই সময়ে নেপালের জন্য এটি বিশাল এক অর্জন ছিল। পরের বছর প্রথমবারের মতন তাঁরা আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করে। কানাডার অন্টারিওতে অনুষ্ঠিত সেই টুর্নামেন্টে তারা জার্মানি ও জিব্রাল্টারকে হারায়। এরপর নামিবিয়ার কাছে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই তাদের বিদায় নিশ্চিত হয়।
২০০২-২০০৫ সাল
সিংগাপুরে অনুষ্ঠিত ২০০২ এসিসি ট্রফিতে নেপাল দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ফাইনালে হেরে তাদের প্রথম শিরোপার স্বপ্নটি অপূর্ণই থেকে যায়। ২০০৩ সালে নেপাল এসিসি ইমার্জিং নেশনস টুর্নামেন্টের আয়োজক হিসেবে শিরোপা জেতে। তারা সহজেই ভুটান ও মালদ্বীপের বিপক্ষে জয় অর্জন করে। তাদের জয় এতোটাই একপেশে ছিল পরবর্তী টুর্নামেন্টে তাদেরকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। রাজু খড়কা প্রথম নেপালি ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করার বিরল গৌরব লাভ করেন। তিনি ভুটানের বিপক্ষে মাত্র ৫০ বলে ১০৫ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন।
২০০৪-২০০৬ সাল
২০০৪ সাল থেকে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা শুরু হয়। ঐ বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মালয়েশিয়ার বিপক্ষে আইসিসি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ড্র করে। এরপর ২০০৪ সালের এসিসি ফাস্ট স্ট্রাক কান্ট্রিস টুর্নামেন্ট যার মাধ্যমে ২০০৫ সালের আইসিসি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের জন্য কোয়ালিফাই করে। ২০০৬ সালের আইসিসি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের সাথে নামিবিয়ার সাথে ড্র করে নেপাল। এই ম্যাচে নেপালের জয় জরুরি ছিল মূলপর্বে অংশগ্রহণ করার জন্য। ঐ বছরেই নেপাল প্রথমবারের মতন পাকিস্তান সফর করে। তারা সেখানে পাকিস্তান ক্রিকেট অ্যাকাডেমির বিপক্ষে ম্যাচ খেলে।
২০০৬ সালের এসিসি ট্রফিতে নেপাল মিয়ানমারকে মাত্র ১২.১ ওভারে ১০ রানে অলআউট করে। সেই ম্যাচে মিয়ানমারের কোনো ব্যাটসম্যানই এক রানের বেশি করতে পারেননি। নেপালের মেহবুব আলম সাত উইকেট শিকার করেন। জবাবে দুই বলের মধ্যেই নেপাল জয় লাভ করে দশ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে। এই ম্যাচকে ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে অসম লড়াই হিসেবে আখ্যায়িত করেন অনেকে। পুরুষ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দশ রান সর্বনিম্ন দলীয় স্কোর। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্লে-অফে হারার পর চতুর্থ হয়ে নেপাল এই টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়। তারা ২০০৬ সালের এসিসি প্রিমিয়ার লীগের ট্রফি জয় করে।
২০০৭-২০০৯ সাল
নেপাল ২০০৭ সালের এসিসি টি-টোয়েন্টি কাপে অংশগ্রহণ করে। কুয়েতে অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টে নেপাল প্রথম রাউন্ড গ্রুপে চতুর্থ হয়ে শেষ করে। ২০০৮ সালে মে মাসে নেপাল ২০০৮ আইসিসি বিশ্ব ক্রিকেট লীগ ডিভিশন ফাইভ খেলার জন্য জার্সিতে সফর করে। মেহবুব আলম এক ম্যাচে পুরো দশ উইকেট নিয়ে বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেন। সীমিত ওভারের আইসিসি টুর্নামেন্টে মোজাম্বিকের বিপক্ষে এই কীর্তির পর আলমের নাম গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে আসে। নেপাল গ্রুপ “এ” এর শীর্ষস্থান দখল করে কিন্তু সেমিফাইনালে আফগানিস্তানের কাছে হেরে যায়। নেপালের ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপের স্বপ্ন এখানেই শেষ হয়ে যায়। নেপাল ২০০৮ সালের এসিসি ট্রফি এলিটে অংশগ্রহণ করে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে হেরে চতুর্থ হয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করে।
২০০৯ সালের এসিসি টি-টোয়েন্টি কাপে পঞ্চম স্থান অর্জন করে। কুয়েতের বিপক্ষে এক গ্রুপ ম্যাচে নেপালের শেষ বলে সাত রানের প্রয়োজন ছিল। সেই ম্যাচেই অভিষিক্ত ক্রিকেটার বিনোদ ভান্ডারী শেষ বলে ছয় মেরে ম্যাচ টাই করেন। এরপর অবশ্য নেপাল বোল আউটে হেরে গিয়েছিল।
Nepal National Cricket Team বিশ্বমঞ্চে উত্থান
2014 সালের ২৮শে জুন আইসিসি নেপালকে টি-টোয়েন্টি স্ট্যাটাস দেয়। নিজেদের ইতিহাসের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে নেপাল হংকংকে আশি রানে পরাজিত করে। চট্টগ্রামে সেই জয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি অঙ্গনে নেপালের পথচলা শুরু হয়। পরে অবশ্য ২০১৫ সালের জুলাই নেপাল ২০১৬ সালের ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে অংশ নিতে ব্যর্থ হয়ে সেই স্ট্যাটাস হারায়। এরপর বহু উত্থান-পতন পেরিয়ে বর্তমানে নেপাল এশিয়া ক্রিকেটের অন্যতম সেরা দল। ২০২৩ সালে ভারতীয় কোচ মন্টি দেশাইকে নিয়োগ দেয়ার পর থেকে নেপালের ক্রিকেট দ্রুতগতিতে এগোতে থাকে। ২০২৩ আইসিসি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ লীগ টুয়ের দশ ম্যাচের নয়টিতে জয়লাভ করে নেপাল পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ওয়ানডে স্ট্যাটাস লাভ করে। পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে ঘরের মাটিতে এক ম্যাচে নেপাল ২৫৩ বল হাতে রেখে নয় উইকেটের এক বিশাল জয় পায়। সেই ম্যাচের নায়ক ছিলেন লেগস্পিনার সন্দীপ লামিচানে। তাঁর ক্যারিয়ারের তৃতীয় পাঁচ উইকেট শিকার নেপালকে এই বিশাল জয় উপহার দেয়। নেপাল পাপুয়া নিউ গিনিকে মাত্র ৯৫ রানে অলআউট করে। এরপর সেই লক্ষ্যকে মাত্র ৭.৪ ওভারে পেরিয়ে যায়। আসিফ শেখের ২১ বলে ৫৩ রানের অপরাজিত ঝড়ো ইনিংস নেপালকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেয়।
২০২৩ সালের ১৮ই জুনে নেপাল পূর্ণাংগ সদস্যের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলে। এটি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার। হারারে স্পোর্টস ক্লাবে নেপাল ঐতিহাসিক এই ম্যাচে স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি হয়। টসে জিতে জিম্বাবুয়ে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। কুশল ভুরতেল ও আসিফ শেখ নেপালের পক্ষে উদ্বোধনী জুটিতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড (১৭১) করেন। ভুরতেলের ৯৫ বলে ৯৯ রানের ইনিংসে চেপে নেপাল ৫০ ওভারে আট উইকেট হারিয়ে ২৯০ রান সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় ইনিংসে সমপাল কামি ও গুলশান ঝা দ্রুত জিম্বাবুয়ের ওপেনিং জুটিকে প্যাভিলিয়নে পাঠান, তবুও জেতে জিম্বাবুয়ে।
২০২৩ সালের এশিয়া কাপ ছিল নেপালের ক্রিকেটের জন্য এক বিরাট অর্জন। তারা বিশ্ব ক্রিকেটের দুই পরাশক্তি ভারত ও পাকিস্তানের সাথে একই গ্রুপে পড়ে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের ৩০ তারিখে নেপাল পাকিস্তানের মুলতান ক্রিকেট স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের মুখোমুখি হয়। নির্ধারিত ৫০ ওভারে পাকিস্তান ৩৪২ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করায়। জবাবে ২৪ ওভারের মধ্যেই নেপাল ১০৪ রানে অলআউট হয়ে যায়। গ্রুপের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল শ্রীলংকার পাল্লেকেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে, ভারতের বিপক্ষে। ইন্ডিয়া টসে জিতে নেপালকে ব্যাটিংয়ে পাঠায়। ৪৯ ওভারে অলআউট হবার আগে নেপাল ২৩০ রান সংগ্রহ করে। আসিফ শেখ ৫৮ রান করেন। বৃষ্টিবিঘ্নিত দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে ১৪৫ রান করে ভারত ডার্কওয়াথ/লুইস পদ্ধতিতে জয়লাভ করে।
২০২৪ ক্রিকেট বিশ্বকাপে Nepal National Cricket Team
আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে বিশ্বমঞ্চে নেপাল দ্বিতীয়বারের মতন খেলার সুযোগ লাভ করে। ২০২৪ সালের জুন মাসের চার তারিখে নেপাল ডালাসে নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হয়। ১০ বছর পর বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ লুফে নিতে মুখিয়ে ছিল নেপালি ক্রিকেটারেরা। প্রবল লড়াইয়ের শেষ পর্যন্ত ডাচদের অভিজ্ঞতার কাছে হার মানতে হয় তাঁদেরকে। নেপাল প্রথমে ব্যাটিং করতে নেমে ১০৬ রান সংগ্রহ করে। এরপর বল হাতে সমান সমানে যুদ্ধ করলেও ম্যাক্স ও’ডাউডের লড়াকু হাফ-সেঞ্চুরির কাছে হার মানে এশীয়রা।
ফ্লোরিডাতে শ্রীলংকার নেপালের দ্বিতীয় ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে যায়। এর ফলে নেপাল এক পয়েন্ট লাভ করে। সেন্ট ভিনসেন্টের আরনস ভেল স্টেডিয়ামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নেপালের ম্যাচ ছিল আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক।
Nepal National Cricket Team বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা
কুশল ভুরতেলের ৪/১৯ ও দীপেন্দ্র সিং আইরী এর ৩/২১ বোলিং পারফর্মেন্সে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেপাল মাত্র ১১৫ রানে আটকে রাখতে সমর্থ হয়। আফ্রিকানদের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করেন রীজা হেনরিকস (৪৭)। জবাবে প্রথম সাত ওভার শেষে নেপাল ৩৪ রানে পৌঁছে যায়। কুশল ভুরতেল ২০ বলে ১৩ রান করেন। তবে, অষ্টম ওভার নেপালের জন্য ছিল বিপর্যয়কর। দক্ষিণ আফ্রিকার চায়নাম্যান বোলার তাবরাইজ শামসি কুশলকে বোল্ড করেন। দুই বল বাদে তিনি আরেকবার স্ট্যাম্পে আঘাত হানেন, এবার শিকার রোহিত পাউডেল – তিনি ফেরেন শুন্য রানে। এরপর আসিফ শেখ এবং অনিল সাহ নেপালকে ১৩ ওভার শেষে ২ উইকেটে ৮২ রানে পৌঁছে দেন। এরপর আবার নাটকের পালাবদল। প্রোটিয়া অধিনায়ক আইডেন মার্করামের বলে প্যাভিলিয়নে ফেরেন অনিল সাহ। মার্কো ইয়ানসেনের দারুণ এক ক্যাচে ফেরার আগে তিনি ২৪ বলে ২৭ রান করেন।
এরপর দীপেন্দ্র সিং আইরিকে নিয়ে আবার ইনিংস মেরামতের কাজ শুরু করেন আসিফ শেখ। ১৭ ওভার শেষে নেপালের জন্য পরিসংখ্যান ছিল বেশ সহজ, ইতিহাস রচনা করতে করতে তাদের ১৮ বলে ১৮ রান লাগতো, হাতে আছে সাতটি উইকেট। এরপর আবার শামসি এসে ম্যাচের গতিপ্রকৃতি বদলে দেন। তাঁর করা ১৮তম ওভারে দুই উইকেট হারায় নেপাল। প্রথমে ১১ বলে ছয় রান করা আইরীকে প্যাভিলিয়নে পাঠান শামসি। তারপর ৪২ বলে ৪৯ রান করা আসিফকে আউট করে ম্যাচে প্রোটিয়াদেরকে ফেরান এই স্পিনার। শেষ দুই ওভারে এরপর নেপালের প্রয়োজন ১২ বলে ১৬ রান, আধুনিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের হিসেবে যেটি সহজেই অর্জনযোগ্য। আনরিখ নরকিয়ার করা উনিশতম ওভারে কুশল মাল্লা বোল্ড হয়ে যান। এরপর সোমপাল কামি এসে নিজের দেশকে আশা যোগান। দুটো ডট বলের পর তিনি ১০০ মিটারের চেয়েও বেশি দূরত্বের বিশাল এক ছক্কা হাঁকান। শেষবলে দুই রানের পর নেপালের পরিসংখ্যান দাঁড়ায় ছয় বলে আট রানের।
ওটনিল বার্টম্যানের করা শেষ ওভারের প্রথম দুই বল ডট হয়। গুলশান ঝা ম্যাচের তৃতীয় বলে বাউন্ডারি হাঁকালে প্রয়োজন দাঁড়ায় তিন বলে চার রান। এরপরের বলে দুই রান নেয়ার পর ফলে পরিসংখ্যান দাঁড়ায় দুই বলে দুই রানে। ওভারের পঞ্চম বলে ব্যাট লাগাতে পারেননি ঝা। শেষ বলে নেপালকে দুই রান করতে হবে জেতার জন্য, সুপার ওভারে নিতে হলে দরকার এক রান। ঝা এই বলও মিস করেন। প্রোটিয়া উইকেটরক্ষক কুইন্টন ডি কক বল ধরে বোলারের প্রান্তে থ্রো করেন। মুহূর্তের দ্বিধার ফলে কয়েক ইঞ্চির ব্যবধানে রান আউট হয়ে যান ঝা। স্বপ্নের একেবারে কাছে গিয়ে নেপালের হৃদয়ভংগ হয়, ম্যাচটি হারে তারা মাত্র এক রানে।
গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচেও বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দিতা তৈরি করেছিল নেপালিরা। প্রথম ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশকে ১০৬ রানের বেশি করতে দেয়নি নেপালের বোলারেরা। কিন্তু তানজিম সাকিবের দুর্দান্ত বোলিংয়ে নেপাল নিজেরাও ৮৫ রানে গুটিয়ে ২১ রানের ব্যবধানে ম্যাচটি হেরে যায়। অনেক আশা জাগিয়েও নেপালের শেষটা হয় আফসোসে মোড়া।
Nepal National Cricket Team এর রেকর্ডসমূহ
নেপাল জাতীয় ক্রিকেট দলের রেকর্ডের হিসেব করলেই সর্বপ্রথমে আসে ২০২৩ সালের এশিয়ান গেমসে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক সেই ম্যাচ। এক ম্যাচেই টি-টোয়েন্টি রেকর্ডবুকে অনেকগুলো নতুন রেকর্ডের মালিক বনে যায় নেপাল। ২০ ওভারে নেপালের করা ৩১৮ রান আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে সর্বোচ্চ দলগত সংগ্রহ। কুশল মাল্লার ৩৪ বলে সেঞ্চুরি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্রুততম সেঞ্চুরির নতুন রেকর্ড। ১৯ বছর ২০৬ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করে মাল্লা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সেঞ্চুরিয়ানদের তালিকায় দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার।
অন্যপ্রান্ত থেকে দীপেন্দ্র সিং আইরিও সতীর্থের মতন রেকর্ডে মেতেছিলেন, তিনি নয় বলে ফিফটি পূরণ করেন। ২০০৫ সালের বিশ্বকাপে যুবরাজ সিংয়ের ১২ বলে দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডটাকে নতুনভাবে লেখা হয়। কমপক্ষে দশ বল খেলা ইনিংসের মধ্যে দীপেন্দ্র সিং আইরির এই ইনিংসের স্ট্রাইক রেট (৫২০) সর্বোচ্চ। এক ইনিংসে ২৬ জয়ের নতুন রেকর্ড গড়ে নেপালিরা। আবার মঙ্গোলিয়া মাত্র ৪১ রানে অলআউট হয়ে যাওায় ২৭৩ রানের বিশাল জয় পায় নেপাল, রানের হিসেবে যেটি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সর্বোচ্চ।
উপসংহার
দক্ষিণ এশিয়ার বাকি অংশের মতন নেপালেও ক্রিকেট দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করা শুরু করছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ সুবিধার সুবাদে নেপালের তৃণমূল পর্যায়ে খেলাটি পৌঁছে গেছে। এই দেশটি থেকে প্রতিভাবান কিছু ক্রিকেটার উঠে এসেছেন, নতুন প্রজন্মেও অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ আছেন। ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নেপালের ক্রিকেটের ইতিহাসে এক বিরাট মাইলফলক হয়ে থাকবে। কোনো ম্যাচ না জিতলে পারলেও এই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে নেপাল প্রমাণ করেছে বিশ্বের কুলীনদের মধ্যে তারা আলাদা অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক রানের পরাজয়টা নেপালিদেরকে পোড়াবে সত্যি, তবে এই জয় নেপালকে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস এনে দেবে। এভাবে উন্নতি করতে থাকলে তারা অচিরেই বিশ্বের সেরা দলগুলোর সাথে একই পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারবে।