‘দ্য গেম অফ জেন্টলমেন‘ বলে খ্যাত ক্রিকেট ম্যাচের প্রতিটি ফলাফল যেন উভয় দলের জন্যই ন্যায়সঙ্গত হয় তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ সকল মুহুর্তের সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য আম্প্যায়ারদের নিযুক্ত করা হয়। মাঠে আপাত: ‘অদৃশ্য‘ ৩য় আম্প্যায়ার সহ প্রতিটি ম্যাচে মোট তিনজন আম্প্যায়ার নিয়োগ করা হয়। আম্প্যায়ার নিয়োগের এই প্রক্রিয়াটি যতটা সহজ মনে হচ্ছে, বাস্তবে মোটেও তা নয়। এর কারণ হল কোনো নির্দিষ্ট ম্যাচে কোন্ আম্প্যায়ারকে নিয়োগ করা হচ্ছে সেই সিদ্ধান্ত এবং ম্যাচ চলাকালে উক্ত আম্প্যায়ারের দেওয়া সিদ্ধান্ত- উভয়েরই ন্যায়সঙ্গতা সম্পর্কে বারংবারং সর্বস্তরের দর্শক ও ভক্তরা প্রশ্ন তুলেছে। আর তাই সময়ের সাথে সাথে আম্প্যায়ার নিয়োগের প্রক্রিয়ায় আনা হয়েছে অনেক প্রয়োজনীয় পরিবর্তন।
সর্বকালের সেরা ১০ জন আম্প্যায়ারের তালিকা
যুগে যুগে অনুষ্ঠিত অসংখ্য ক্রিকেট ম্যাচে নিয়োজিত আম্প্যায়ারদের মাঝে এমন অনেকেই আছেন যারা নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে যেমন কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন, তেমনি ভক্তদের হৃদয়েও নিজেদের জন্য বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন। এমনকি, ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে দেওয়া সিদ্ধান্ত যেন ন্যায়সঙ্গত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য আইসিসি অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ম্যাচে একজন নিরপেক্ষ আম্প্যায়ার নিয়োগ করার জন্য একটি এলিট প্যানেলও গঠন করেছে। কিন্তু ঐ প্যানেল সম্পর্কে অন্য কোনো আর্টিকেলে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে। আপাতত চলুন জেনে নিই ক্রিকেট বিশ্বের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ১০ জন আম্প্যায়ার সম্পর্কে।
ক্রমিক নং | নাম | দেশ | নিয়োগকাল |
০১ | হ্যারল্ড ‘ডিকি‘ বার্ড | ইংল্যাণ্ড | ১৯৭৩-৯৬ |
০২ | ডেভিড শেফার্ড | ইংল্যাণ্ড | ১৯৮৩-২০০৫ |
০৩ | স্টিভ বাকনর | জ্যামাইকা | ১৯৮৯-২০০৯ |
০৪ | সায়মন টফেল | অস্ট্রেলিয়া | ১৯৯৯-২০১২ |
০৫ | রুডি কার্টজেন | দক্ষিণ আফ্রিকা | ১৯৯২-২০১০ |
০৬ | বিলি বাওডেন | নিউ জিল্যাণ্ড | ১৯৯৫-২০২১ |
০৭ | শ্রীনিভাস ভেঙ্কটরঘবন | ভারত | ১৯৯৩-২০০৪ |
০৮ | আলীম দার | পাকিস্তান | ২০০৩-২৩ |
০৯ | ইয়ান গুল্ড | ইংল্যাণ্ড | ২০০৬-১৯ |
১০ | ড্যারিল হার্পার | অস্ট্রেলিয়া | ১৯৯৪-২০১১ |
কেন তারা সর্বকালের সেরা আম্প্যায়ার?
এই তালিকায় উল্লেখিত শীর্ষস্থানীয় এই ১০ জন আম্প্যায়ার ছাড়াও আরও অনেক প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় আম্প্যায়ার ক্রিকেট ম্যাচে দায়িত্ব পালন করে ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ হয়েছেন। এমনকি এই তালিকায় ‘আইসিসি এলিট প্যানেল অফ আম্প্যায়ার্স‘ এর সকল আম্প্যায়ারের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কাজেই এই তালিকায় এই ১০ জন আম্প্যায়ারের অন্তর্ভুক্ত হওয়া নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক। তালিকায় কেন এই ১০ আম্প্যায়ারকেই অন্তর্ভুক্ত করা হল এবং কী কারণে তারা অন্যান্য আম্প্যায়ারদের থেকে আলাদা তা জানার জন্য আর্টিকেলটির শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
ডিকি বার্ড: ৬৬ টি টেস্ট ও ৬৯ টি ওডিআই ম্যাচ
ক্রিকেটের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সময়সীমার মধ্যে আইসিসি‘র ৩টি বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম আম্প্যায়ার ডিকি বার্ড। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই এই তালিকায় শীর্ষস্থানে তার নাম থাকার পক্ষে এই একটি কারণই যথেষ্ট। স্বকীয় হাস্যরসবোধ, ব্যক্তিত্বের বিশেষত্ব এবং সর্বোপরি, একজন প্রকৃত ইংরেজ পুরুষের ন্যায় সভ্য আচরণের কারণে তাকে এযাবত্কালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় আম্প্যায়ার বললেও ভুল বলা হবে না।
স্টিভ ওয়াহ ও ব্রায়ান লারার সাথে ডেভিড শেফার্ড
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আম্প্যায়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করার আগে বার্ড, ‘বার্নসলি সিসি‘ দলের হয়ে ক্রিকেট খেলতেন এবং তার দলে খেলা অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন জেফ বয়কট ও লেখক/সম্প্রচারক মাইকেল পার্কিনসন। ইংল্যাণ্ড ও নিউ জিল্যাণ্ডের মধ্যে ১৯৭৩ সালে হেডিংলী-তে অনুষ্ঠিত ম্যাচে প্রধান আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সূচনা হয়।
ক্রিকেট ম্যাচের টানটান উত্তেজনা ও প্রচণ্ড চাপের মাঝেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারার সামর্থ্যের জন্যই গোটা ক্রিকেট বিশ্বের কাছে ডিকি, ‘আম্প্যায়ারদের সুপারস্টার‘ হিসেবে খ্যাত। ১৯৯৬ সালে লর্ডস-এর মাটিতে ইংল্যাণ্ড ও ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচটিই ছিল আন্তর্জাতিক আম্প্যায়ার হিসেবে তার দায়িত্বপ্রাপ্ত তার শেষ টেস্ট ম্যাচ ও শেষ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। ঐ ম্যাচ শেষে খেলোয়াড়েরা সকলে তাকে ‘গার্ড অফ অনার‘ প্রদান করে এবং গ্যালারীতে উপস্থিত দর্শকেরা ‘স্ট্যাণ্ডিং ওভেশন‘ প্রদান করে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের আম্প্যায়ার হিসেবে ২৩ বছরের ক্যারিয়ারে ৬৬ টি টেস্ট ম্যাচ ও ৬৯ টি ওডিআই ম্যাচ সহ আইসিসি-র ৩ টি বিশ্বকাপের ফাইনালে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়াটাই জীবনে প্রাপ্ত সকল সম্মানের জন্য যথার্থই যোগ্য করে তুলেছে তাকে। পেশাগত জীবনে নিজের অর্জনের মাধ্যমে তিনি ভবিষ্যতের সকল আম্প্যায়ারদের জন্য নিজেকে যেমন আদর্শ অনুপ্রেরণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তেমনি নিজেকে করে তুলেছেন একজন জীবন্ত কিংবদন্তী।
ডেভিড শেফার্ড: ৯২ টি টেস্ট ও ১৭২ টি ওডিআই ম্যাচ
ডেভিড শেফার্ড, বোধ হয়, ক্রিকেট মাঠে উপস্থিত সকলের সবচেয়ে প্রিয় মুখ। এমনকি, আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে, গোটা বিশ্বজুড়ে যে সকল ক্রিকেটপ্রেমীই তাকে মাঠে দায়িত্বরত অবস্থায় দেখেছে, তাদের মাঝে কেউই হয়তো তাকে অপছন্দও করেনা। ক্রিকেট ম্যাচে সবচেয়ে বেশি সঠিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার সামর্থ্য এবং তার সদা হাস্যোজ্জ্বল, উষ্ণ ব্যক্তিত্বের কারণেই খেলোয়াড় ও দর্শক- উভয়ের কাছেই তিনি এতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। মাঠের যে কোনো বিতর্কিত বিষয় তিনি সব সময় সহানুভূতি ও সমবেদনার সাথে ব্যবস্থাপনা করেছেন।
ক্রিকেট আম্প্যায়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করার আগে তিনি গ্লুসেস্টারশায়ারের হয়ে ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেট খেলতেন এবং ১৪ টি ম্যাচে তিনি মিডল্-অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেছেন। কাউন্টি ক্রিকেটে নিজের ক্যারিয়ারের ইতি টেনে ১৯৮১ সালে তিনি আন্তর্জাতিক আম্প্যায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অর্জন করেন। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আম্প্যায়ার হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয়। ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড-এ অনুষ্ঠিত ১৯৮৫ সালের অ্যাসেজ সিরিজের ৪র্থ ম্যাচে তার টেস্ট ক্যারিয়ারের সূচনা হয়।
ডিকি‘র মত ডেভিড ও ১৯৯৬, ১৯৯৯ ও ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি‘র ৩ টি বিশ্বকাপ ফাইনালে দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আম্প্যায়ার হিসেবে তার উজ্জ্বল ক্যারিয়ারে তিনি মোট ৯২ টি টেস্ট ম্যাচ ও ১৭২ টি ওডিআই ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ ছিল ২০০৫ সালে লর্ডস-এ অনুষ্ঠিত অ্যাসেজ সিরিজের একটি ম্যাচ যেখানে খেলোয়াড়েরা তাকে ‘গার্ড অফ অনার‘ প্রদান করে। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে সবার প্রিয় এই আম্প্যায়ার পৃথিবী থেকে শেষ বিদায় গ্রহণ করেন।
স্টিভ বাকনর: ১২৮ টি টেস্ট ও ১৮২ টি ওডিআই ম্যাচ
এই তালিকায় উল্লেখিত আম্প্যায়ারদের মধ্যে একাধিক কারণে স্টিভ বাকনর একজন অতুলনীয় প্রার্থী। তিনি যে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচেই দায়িত্ব পালন করেছেন তা-ই নয়, তিনি ফুটবল ম্যাচেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আর উভয় ক্ষেত্রেই তিনি রীতিমত বিশ্বকাপ আসরে দায়িত্ব পালন করেছেন। আইসিসি‘র বিশ্বকাপের মোট ৫ টি ফাইনালে তিনি আম্প্যায়ার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। চমকের এখানেই শেষ নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আম্প্যায়ার হিসেবে ১০০ টি টেস্ট ম্যাচে দায়িত্ব পালনের গৌরব অর্জনকারী তিনিই প্রথম। তিনি মোট ১৪ টি অ্যাশেজ ম্যাচে দায়িত্বরত ছিলেন।
তবে আম্প্যায়ার হিসেবে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়টি হল ‘স্লো ডেথ‘ ডাকনাম অর্জন করা। এরকম নামকরণের কারণ, কোনো ব্যাটসম্যানকে আউট করেছেন- কোনো বোলারের এই দাবির জবাবে হাতের আঙ্গুল উঁচু করে কোনো আম্প্যায়ার তার সিদ্ধান্ত জানাতে সাধারণত যে সময় নিয়ে থাকেন, স্টিভ তার চেয়ে তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশিই সময় নিতেন। স্বাভাবিকভাবেই এই সময়ে বোলার ও ব্যাটসম্যান উভয়ের অবস্থাই যে মরণাপন্নপ্রায়, তা বলাটা হয়তো ভুল হবে না। ১৯৮৮-৮৯ সময়কালে তিনি আম্প্যায়ার হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। ২০০৫ সাল নাগাদ তিনি ১০০ টি টেস্ট ম্যাচে দায়িত্ব পালনের কৃতিত্ব অর্জন করেন। ২০০৯ সালে কেপ টাউনে, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচটিই ছিল আম্প্যায়ার হিসেবে তার ক্যারিয়ারের ১২৮ তম ও শেষ টেস্ট ম্যাচ।
ক্রিকেট জগতের কিংবদন্তী শচীন তেন্দুলকারের সাথে স্টিভ বাকনর
একই বছরে ইংল্যাণ্ড ও ওয়েস্ট ইণ্ডিজের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি একদিনের ম্যাচই ছিল তার ক্যারিয়ারের ১৮২ তম ও শেষ ওডিআই ম্যাচ। ঐ ম্যাচের খেলোয়াড়েরা ‘গার্ড অফ অনার‘ প্রদানের মাধ্যমে তাকে বিদায় জানায়। ক্রিকেট ছাড়াও, আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচের একজন পরিপূর্ণ রেফারি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে তার উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময়টি ছিল ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়িং পর্বের একাধিক ম্যাচে দায়িত্ব পালন।
সায়মন টফেল: ৭৪ টি টেস্ট, ১৭৪ টি ওডিআই ও ৩৪ টিটোয়েন্টি ম্যাচ
২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত একাধারে পাঁচ বছর যাবত্ ‘আইসিসি আম্প্যায়ার অফ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড‘ অর্জনের কারণে সায়মন টফেলকে অনায়াসেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বসেরা আম্প্যায়ারদের মধ্যে একজন বলা যেতেই পারে। ১৯৯৯ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আম্প্যায়ার হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয়। সেটা ছিল সিডনীতে, অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি ওডিআই ম্যাচ। ২০০০ সালে মেলবোর্ন-এ অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইণ্ডিজের মধ্যে অনুষ্ঠিত ‘বক্সিং ডে টেস্ট‘-এ আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচের আম্প্যায়ার হিসেবে তার অভিষেক ঘটে।
৭৪ টি টেস্ট, ১৭৪ টি ওডিআই ও ৩৪ টি টিটোয়েন্টি ম্যাচের আম্প্যায়ার হিসেবে সায়মনের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারে ২০০৩ সালের আইসিসি বিশ্বকাপ ও ২০০৪ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি‘র ফাইনাল ম্যাচ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ২০১২ সালের আইসিসি টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের পরে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ১০০ টি ওডিআই ম্যাচে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রদত্ত ‘আইসিসি ব্রোঞ্জ বেইল্স অ্যাওয়ার্ড‘ প্রাপ্ত তিনি সর্বকনিষ্ঠ আম্প্যায়ার।
রুডি কার্টজেন: ১০৮ টি টেস্ট, ২০৯ টি ওডিআই ও ১৪ টি টিয়োন্টি ম্যাচ
১০০ টি টেস্ট ম্যাচের জন্য ‘আইসিসি গোল্ডেন বেইল্স অ্যাওয়ার্ড‘, ১০০ টি ওডিআই ম্যাচের জন্য ‘আইসিসি ব্রোঞ্জ বেইল্স অ্যাওয়ার্ড‘, এবং ২০০ টি ওডিআই ম্যাচের জন্য ‘আইসিসি সিলভার বেইল্স অ্যাওয়ার্ড‘- আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আম্প্যায়ার হিসেবে অসাধারণভাবে দায়িত্ব পালনের কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ এই সকল পুরস্কার প্রাপ্ত একমাত্র আম্প্যায়ার হলেন রুডি কার্টজেন।
স্টিভ বাকনরের মতও রুডিও ব্যাটনসম্যান আউট হয়েছে তা নির্দেশ করার জন্য তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে আঙ্গুল তোলার জন্য খ্যাতি লাভ করেন। ২০০৯ সালে লর্ডসে অনুষ্ঠিত অ্যাশেজ সিরিজের ২য় টেস্টে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, স্টিভ বাকনরের পরে রুডিও তার ক্যারিয়ারে ১০০ টি টেস্ট ম্যাচের মাইলফলক অর্জন করেন। ২০০২ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে, ২০০৩ ও ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি‘র বিশ্বকাপ আসর সহ- যেখানে তিনি সেমিফাইনালে মাঠে এবং ফাইনাল ম্যাচে ৩য় আম্প্যায়ার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন- তিনি মোট ১০৮ টি টেস্ট, ২০৯ টি ওডিআই ও ১৪ টি টিটোয়েন্টি ম্যাচে আম্প্যায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ ও ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি‘র চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল ম্যাচেও তিনি মাঠে আম্প্যায়ার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
২০০৭ সালে একদিনের বিশ্বকাপে বার্বাডোজ-এ ইংল্যাণ্ড ও ওয়েস্ট ইণ্ডিজের এর মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তিনি, ডেভিড শেফার্ডের ১৭২ টি ওডিআই ম্যাচে আম্প্যায়ার হিসেবে নিয়োজিত হওয়ার রেকর্ডটি ভাঙ্গেন। ভোটের মাধ্যমে, ২০০২ সালে তিনি অফিসিয়্যালি ‘বেস্ট আম্প্যায়ার‘ হিসেবে নির্বাচিত হোন।
বিলি বাওডেন: ৮৫ টি টেস্ট, ২২১ টি ওডিআই ও ৪৯ টি টিটোয়েন্টি ম্যাচ
রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস বা গেঁটে বাতের সাথে কষ্টকর জীবনযুদ্ধের ফলস্বরূপ ক্রিকেট ম্যাচে আম্প্যায়ার হিসেবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য হাতের আঙ্গুল ব্যবহারের এক স্বকীয় পদ্ধতি অবলম্বন করতে বাধ্য হোন বিলি বাওডেন। আর এভাবেই ক্রিকেট ইতিহাসের বিখ্যাত ‘ক্রুকেড ফিঙ্গার অফ ডুম‘ বা ‘ধ্বংসের বাঁকা আঙ্গুল‘-এর সৃষ্টি হয় যা বিলিকে গোটা ক্রিকেট বিশ্বে বিশেষ জনপ্রিয়তা এনে দেয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তিনি পুরুষদের ৮৪ টি টেস্ট, ২০০ টি ওডিআই ও ২৪ টি টিটোয়েন্টি ম্যাচে এবং নারীদের ১ টি টেস্ট, ২১ টি ওডিআই ও ২৫ টি টিটোয়েন্টি ম্যাচে আম্প্যায়ার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
ইংরেজ ক্রিকেটারদের সাথে সায়মন টফেল
১৯৯৫ সালে হ্যামিল্টনে নিউ জিল্যাণ্ড ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে অনুষ্ঠিত একদিনের ম্যাচের মাধ্যমে ওডিআই ক্রিকেটে তার অভিষেক ঘটে। আর ২০০৭ সালে এই দুইটি দলের মধ্যে ঐ একই স্থানে অনুষ্ঠিত একদিনের ম্যাচের মাধ্যমে তিনি সর্বকণিষ্ঠ আম্প্যায়ার হিসেবে ১০০ টি ওডিআই ম্যাচে দায়িত্ব পালনের রেকর্ড গড়েন। ২০১৬ সালে নিউ জিল্যাণ্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত একদিনের ম্যাচে তিনি ব্যক্তিগত ২০০ টি ওডিআই ম্যাচে নিয়োজিত হওয়ার মাইলফলক অর্জন করেন।
২০০০ সালে আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচে আম্প্যায়ার হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয়। ফাইনাল ম্যাচসহ ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ আসরেও তিনি কর্মরত ছিলেন। ‘আইসিসি এমিরেটস্ প্যানেল অফ ইন্টারন্যাশনাল আম্প্যায়ার্স‘ এর একজন সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তারপরে ধীরে ধীরে পদন্নোতির মাধ্যমে তিনি ‘এমিরেটস্ এলিট প্যানেল অফ আইসিসি আম্প্যায়ার্স‘-এ স্থান করে নেন।
শ্রীনিভাস ভেঙ্কটরঘবন: ৭৩ টি টেস্ট ও ৫২ টি ওডিআই ম্যাচ
সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য শ্রীনিভাস ভেঙ্কটরঘবনকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আম্প্যায়ারদের মধ্যে একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে ইংল্যাণ্ড ও ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচেই আন্তর্জাতিক একদিনের ও টেস্ট ম্যাচে তার অভিষেক ঘটে। ১৯৯৪ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট আম্প্যায়ার প্যানেল‘-এর উদ্বোধনী প্যানেলে তিনি জায়গা করে নেওয়ার পর থেকে ভারতের বাইরে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচে একজন নিরপেক্ষ আম্প্যায়ার হিসেবে তাকে নিয়মিতভাবেই নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৯৬ ও ১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি‘র একদিনের বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল এবং লর্ডস-এ অনুষ্ঠিত ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ সহ তিনি মোট ৭৩ টি টেস্ট ও ৫২ টি ওডিআই ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেন। একজন ব্যাটসম্যানকে আউট ঘোষিত করতে ‘বেন্ট এলবো‘ বা ‘বাঁকা কনুই‘ এর মাধ্যমে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য তিনি ক্রিকেট বিশ্বে স্বকীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। আইসিসি‘র প্রথম ‘এলিট প্যানেল অফ আম্প্যায়ার্স‘-এ তিনি অন্তর্ভুক্ত হোন এবং ২০০৪ সালে ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত তিনি এই প্যানেলের একজন সদস্য ছিলেন।
আলীম দার: ১৭২ টি টেস্ট, ২৯৯ টি ওডিআই ও ৯৩ টি টিটোয়েন্টি ম্যাচ
ক্রিকেট ম্যাচে প্রায় সকল সময়েই সঠিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার সামর্থ্যের কারণে আলীম দার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জগতে প্রসিদ্ধ আম্প্যায়ারদের মধ্যে একজন হিসেবে বিবেচিত। ২০০০ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু হয় এবং ২০০২ সালে তিনি আইসিসি‘র প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত হোন। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি‘র বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালনের মাত্র ছয় মাস পরেই তিনি শীর্ষ প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত হোন। ২০০৯-১১ সালের সময়কালে টানা তিনবার তিনি ‘আইসিসি আম্প্যায়ার অফ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড‘-এ ভূষিত হোন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আম্প্যায়ার হিসেবে তার ক্যারিয়ারে তিনি সর্ব্বোচ্চ সংখ্যক ম্যাচে দায়িত্বরত ছিলেন যার মধ্যে রয়েছে ১৭২ টি টেস্ট, ২৯৯ টি ওডিআই এবং ৯৩ টি (৮৮ টি পুরুষদের ও ৫ টি নারীদের) টিটোয়েন্টি ম্যাচ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ও আয়ারল্যাণ্ডের মধ্যে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচটি ছিল তার ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচ। ম্যাচের শেষ উভয় দলের খেলোয়াড়েরাই তাকে ‘গার্ড অফ অনার‘ প্রদান করে এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তাকে একটি মেমেন্টো বা স্মারকচিহ্ন উপহার দেয়।
ইয়ান গুল্ড: ৭৪ টি টেস্ট, ১৪১ টি ওডিআই ও ৩৭ টি টিটোয়েন্টি ম্যাচ
ইংল্যাণ্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার ইয়ান গুল্ড ২০০৯ সালে আইসিসি‘র ‘এলিট প্যানেল অফ আম্প্যায়ার্স‘- এর অন্তর্ভুক্ত হোন। ২০০৮ সালে ব্লেমফোন্টিনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যেকার টেস্ট ম্যাচের মাধ্যমে আম্প্যায়ার হিসেবে তারা ক্যারিয়ার শুরু হয়। ২০১৫ সালের আইসিসি‘র বিশ্বকাপ আসরের পুল এ-র দুই দল শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তিনি তার ক্যারিয়ারের ১০০ তম ওডিআই ম্যাচের মাইলফলক অর্জন করেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আম্প্যায়ার হিসেবে তার গোটা ক্যারিয়ারে তিনি মোট ৭৪ টি টেস্ট, ১৪১ টি ওডিআই এবং ৩৭ টি টিটোয়েন্টি ম্যাচে নিয়োজিত ছিলেন। এসকল ম্যাচের মধ্যে ২০০৭, ২০১১ ও ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি‘র বিশ্বকাপ আসরও রয়েছে।
ড্যারিল হার্পার: ৯৫ টি টেস্ট, ১৭৬ টি ওডিআই ও ১০ টি টিটোয়েন্টি ম্যাচ
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অস্ট্রেলীয় আম্প্যায়ার ড্যারিল হার্পার ছিলেন আইসিসি‘র ‘এলিট প্যানেল অফ আম্প্যায়ার্স‘- এর নির্বাচিত প্রথম সদস্য। তিনি ২০০২ সালে এই প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত হোন এবং ২০১১ সালে তার ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত এর সদস্য ছিলেন। ১৯৯৪ সালে পার্থে নিউ জিল্যাণ্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে অনুষ্ঠিত একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের মাধ্যমে তার ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের অ্যাশেজ সিরিজের ২য় টেস্টে তার আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচে অভিষেক হয়। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি‘র বিশ্বকাপ সহ গোটা ক্যারিয়ারে তিনি মোট ৯৫ টি টেস্ট, ১৭৬ টি ওডিআই এবং ১০ টি টিটোয়েন্টি ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেন। তার ক্যারিয়ারের ১০০ তম ম্যাচটি ২০০৫ সালে হারারে-তে নিউ জিল্যাণ্ড ও জিম্বাব্যুইয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।
ডেভিড শেফার্ডের সঙ্গে শ্রীনিভাস ভেঙ্কটরঘবন
এই দশজন কিংবদন্তীতুল্য আম্প্যায়ার ছাড়াও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন আরও অনেক আম্প্যায়ার আছেন যারা নিজেদের পার্ফর্ম্যান্স এবং চরম উত্তেজনার সময়েও মাথা ঠাণ্ডা রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্যের মাধ্যমে এই খেলার মান উত্তরোত্তর উন্নত করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। কিন্তু এই ১০ জন ভদ্রলোক নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে তাদের কাজের মানদণ্ডটি এত উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন যে পরবর্তী প্রজন্মের সকল আম্প্যায়ারদের জন্য তারা আজীবন আদর্শ অনুপ্রেরণা ও শিক্ষার উত্স হয়ে থাকবেন। ক্রিকেট খেলায় তাদের এই অসাধারণ অবদানের জন্য আমরা সকলেই তাদের কাছে একান্ত কৃতজ্ঞ।