আধুনিক ক্রিকেট বিভিন্ন নিয়মকানুনের কারণে আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। এক সময় যেখানে ৬০ ওভারে সংগৃহীত ২৫০ রানকে অনেক বড় লক্ষ্য বিবেচনা করা হতো, আজ ২০ ওভারের খেলায় একই সংখ্যক রান সংগ্রহের পরেও দলের জয় নিশ্চিত করা যায় না। কিন্তু নিয়ম কানুন যা-ই হোক না কেন, দলের হতাশাজনক পার্ফর্ম্যান্সের পরেও একজন ‘ফিনিশার‘-এর মোটামুটিভাবে একক যোগ্যতায় প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচে জয়লাভ করার নিদর্শন ক্রিকেট জগতে বিরল বা নতুন নয়, যদিও ‘ফিনিশার‘ শব্দটির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক ও আধুনিক। এই আর্টিকেলটি বিশ্ব ক্রিকেটের শীর্ষ ১৫ জন ফিনিশারকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে।
‘ফিনিশার‘ শব্দের গুরুত্ব
দুই দলের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি ক্রিকেট ম্যাচে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করা দলকে বেশ অনেক সময়েই ছত্রভঙ্গ আচরণ করতে দেখা যায়- তা হতে পারে ম্যাচ জেতার মানসিক চাপে বা বিপক্ষ দলের বোলারদের অত্যন্ত ভাল বোলিং-এ ধরাশায়ী হয়ে। মাঝে মাঝে তুলনামূলক ছোট লক্ষ্যের দিকে দৌড়ানোর বেলায়ও এমনটা ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু আবার এমনটাও দেখা যায় যে তুলনামূলকভাবে বড় একটি লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নেমে, দলের বেশিরভাগ ব্যাটসমেনের বাজে পার্ফর্ম্যান্সের পরেও কোনো কোনো দল বিজয় ছিনিয়ে আনতে সফল হয়েছে।
এরকম প্রায় হাতে এসেও পিছলে হারিয়ে যাওয়া ম্যাচেও জয়ের পিছনে থাকেন এমন একজন ব্যাটসম্যান যিনি শত চাপের মুখে মাথা ঠাণ্ডা রেখে, ক্রিজে লম্বা সময় ধরে টিকে থেকে, দলকে ক্রমাগত অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যান এবং এক পর্যায়ে জয় ছিনিয়ে আনেন। এমনটা জরুরী নয় যে তিনি ঐদিনে দলের জন্য সর্ব্বোচ্চ সংখ্যক রান সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু তিনি বেশ পরিকল্পিতভাবে ঝুঁকি নিয়ে, শেষ পর্যন্ত নিয়মিত গতিতে ব্যাট করে রানের চাকা চালিয়ে নিতে থাকেন।
এরকম ধৈর্য্যশীল, মেধাবী ও অত্যন্ত পেশাদার ব্যাটসম্যানকে আধুনিক ক্রিকেট জগতে ‘ফিনিশার‘ বলে আখ্যায়িত করা হয়। আধুনিক যুগের এই নতুন ধারার ক্রিকেটে ফিনিশার শব্দটির এবং ফিনিশার ব্যাটসম্যানের গুরুত্ব অপরিসীম। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন ব্যাটসম্যান নিজেদের মারমুখো কিন্তু হিসাবি ব্যাটিং নৈপুণ্যে নিজেদের নামের পাশে ‘ফিনিশার‘ তকমা জুরে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম সেরা ফিনিশার এবি ডি ভিলিয়ার্স
সর্বকালের সেরা ১৫ জন ফিনিশার ব্যাটসমেন
পাকিস্তানের প্রাক্তন ব্যটাসম্যান জাভেদ মিয়াদাদ ছিলেন ফিনিশারদের মধ্যে প্রথম প্রজন্মের একজন। নব্বই এর দশকের শেষের দিকে এবং একবিংশ শতকের প্রথম দিকের ফিনিশারদের মধ্যে মাইকেল বেভান, আব্দুল রাজ্জাক ও অরবিন্দ ডি সিলভা-র নাম উল্লেখযোগ্য। আর সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি নি:সন্দেহে সর্বকালের সেরা ফিনিশার, বিশেষ করে ২০১১ সালের একদিনের বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে তার অসাধারণ ব্যাটিং যেভাবে দলকে বিজয় এনে দিয়েছিল তারপর থেকে এই বিষয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই বললে ভুল বলা হবে না।
ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ১৫ জন ফিনিশারের সম্পর্কে জানার জন্য এই আর্টিকেলটির শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। এই তালিকায় উল্লেখ করা হয়নি কিন্তু নিজের প্রতিভা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে অগণিতবার দেশকে অপ্রত্যাশিত জয় এনে দিয়েছেন এমন অনেক ফিনিশারের দৃষ্টান্ত ক্রিকেটের ইতিহাসে বিদ্যমান। তবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ব্যাটসমেনেরা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি কৃতিত্বের অধিকারী বলেই তাদের নাম এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে অন্তর্ভুক্ত ফিনিশারদের কৃতিত্ব ও তার পার্ফর্ম্যান্সের গুরুত্বের উপর ভিত্তি করেই এই তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে, তাদের দেশ বা ব্যক্তিগত রেকর্ড বা বয়স বিবেচনায় আনা হয়নি।
ক্রমিক নং | নাম | দেশ |
০১ | মহেন্দ্র সিং ধোনি | ভারত |
০২ | এবি ডি ভিলিয়ার্স | দক্ষিণ আফ্রিকা |
০৩ | জস বাটলার | ইংল্যাণ্ড |
০৪ | গ্লেন ম্যাক্সওয়েল | অস্ট্রেলিয়া |
০৫ | ডেভিড মিলার | দক্ষিণ আফ্রিকা |
০৬ | ল্যান্স ক্লুজনার | দক্ষিণ আফ্রিকা |
০৭ | কিরণ পোলার্ড | ওয়েস্ট ইণ্ডিজ |
০৮ | মাইকেল বেভান | অস্ট্রেলিয়া |
০৯ | মহেলা জয়াবর্ধনে | শ্রীলঙ্কা |
১০ | ইওয়ান মর্গেন | ইংল্যাণ্ড |
১১ | শহীদ আফ্রিদি | পাকিস্তান |
১২ | রবীন্দ্র জাদেজা | ভারত |
১৩ | মাইকেল হাসি | অস্ট্রেলিয়া |
১৪ | স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস | ওয়েস্ট ইণ্ডিজ |
১৫ | জাভেদ মিয়াদাদ | পাকিস্তান |
মহেন্দ্র সিং ধোনি (ভারত)
‘ক্যাপ্টেন কুল‘ নামে খ্যাত ভারতের প্রাক্তন ও সর্বকালের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি স্নায়বিক চাপ নিয়ন্ত্রণের রাখার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন, এরকম নজির বিশ্ব ক্রিকেটে বিরল। ব্যক্তিগত কোনো বড় ইনিংস খেলে রেকর্ড গড়া বা শীর্ষ ব্যাটসম্যানের তালিকায় বারবার নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত হতে দেখা- এরকম ব্যক্তিগত অর্জন তার ক্যারিয়ারে তেমন একটা নেই, কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে দলকে বারবার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং আইসিসি‘র সকল ট্রফিই অধিনায়ক হিসেবে গ্রহণ করার রেকর্ডটি তিনি ঠিকই অর্জন করেছেন। সেই সাথে আইপিএল-এও তার সাফল্য ও নৈপুণ্য একইরকম প্রসিদ্ধ।
ক্রিকেট মাঠে উইকেটের মাঝে তুলনামূলকভাবে দ্রুততর গতিতে দৌড়ানোর সামর্থ্য, বোলার এর পরবর্তী পদক্ষেপ প্রতিবারই প্রায় নির্ভুলভাবে অনুমান করে নিজের পদক্ষেপ গ্রহণ করার দক্ষতা, প্রচণ্ড চাপের মুখেও দৃঢ়ভাবে মাথা ঠাণ্ডা রেখে, হিসেব করে ঝুঁকি নেওয়া এবং নিজের সেরাটা দিয়ে শেষ অব্দি মাঠে থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া- এসবই যেন ধোনির নামেরই প্রতিশব্দ।
বিপক্ষ দলের বেঁধে দেওয়ার রান সংগ্রহের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ভারতকে জয় এনে দেওয়ার ক্ষেত্রে ধোনির গড় ১০০ রানেরও বেশি এবং একই পরিপ্রেক্ষিতে মোট সংগ্রহ ২১০০ রানেরও বেশি। কিন্তু ২০১১ সালের একদিনের বিশ্বকাপ ফাইনালের টানটান উত্তেজনাকর ম্যাচে ৯১ রানে নট আউট থেকে ২৮ বছর পরে ভারতকে বিজয় এনে দেওয়ার কৃতিত্ব নিশ্চিতভাবেই তার ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন।
এবি ডি ভিলিয়ার্স (দক্ষিণ আফ্রিকা)
‘মি. ৩৬০‘ – দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন ব্যাটসম্যান এবি ডি ভিলিয়ার্স ক্রিকেট মাঠের যে কোনো দিক থেকেই সমান দক্ষতায় রান সংগ্রহ করতে পারার সামর্থ্যের কারণে এই খেতাব অর্জন করেন। বিশেষত ম্যাচের ডেথ ওভারে তার মাঠে বিদ্যমান থাকার অর্থ- লক্ষ্য যতই বড় হোক না কেন, খেলার পরিণতি একদম শেষ বলেই নিশ্চিত হবে। ধোনি‘র পরেই তাই বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিনিশার এবি ডি ভিলিয়ার্স।
দলকে বিজয় এনে দেওয়ার পাশাপাশি তার ব্যাক্তিগত অর্জনও কোনো অংশে কম প্রশংসনীয় নয়। আহমেদাবাদে ভারতের বিপক্ষে মাত্র ৫৯ বলে করা তার ১০২ রানের নট আউট ইনিংসে তিনি একদিনের ক্রিকেটে ৭ম দ্রুততম শতরানের রেকর্ড গড়েন। রান চেজে দলকে বিজয় এনে দেওয়া ব্যাটসম্যান হিসেবে তার ক্যারিয়ারের সময়কালে তার গড় ছিল ৫০ রানেরও বেশি এবং স্ট্রাইক রেট ছিল ১০০ রানেরও বেশি। আইপিএল-এ তার অসাধারণ সব ইনিংস যে কোনা ক্রিকেটপ্রেমীর মনেই অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জস বাটলার (ইংল্যাণ্ড)
এই তালিকার দ্বিতীয় উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান ইংল্যাণ্ডের জস বাটলার নিজের ব্যাটিংকে এতটাই উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন যে তার সতীর্থরা কেউই কাছাকাছি নেই। আর এজন্য়ই হয়তো তিনিও সর্বকালের সেরা ১৫ জন ফিনিশারের এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। ক্রিকেটের তিনটি ফর্ম্যাটেই তার এই নৈপুণ্য সমানতালে বিদ্যমান এবং দিনের পর দিন তিনি নিজের দক্ষতাকে আরও শাণিত করে ফিনিশার খেতাবটিকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছেন।
২০১৯ সালে আইসিসি‘র বিশ্বকাপে ইংল্যাণ্ডের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পিছনে তার কৃতিত্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে তাকে অন্যান্যদের চেয়ে বেশ অনেকটাই উপরে স্থান পাইয়ে দিয়েছে। এমনকি অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, জস যেভাবে নিজেকে দিনের পর দিন উন্নত করে চলেছেন তাতে তিনি আগত বছরগুলোতে ধোনির সমকক্ষও হয়ে উঠতে পারেন। একদিনের ক্রিকেটে তার বর্তমান স্ট্রাইক রেট ১১৮ এবং টেস্টে তার স্ট্রাইক রেট ১৪১।
ইংল্যাণ্ডের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ও সেরা ফিনিশার ইওয়ান মর্গেন
গ্লেন ম্যাক্সওয়েল (অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়ার এই দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান যদিও প্রায় কখনই তার প্রতিভার যথেষ্ট প্রমাণ ব্যাটে-বলে তুলে ধরতে পারেননি, কিন্তু তিনি যে ব্যাট হাতে কতটা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারেন তা ২০২৩ সালের একদিনের বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে করা ২০১ রানের নট আউট ইনিংসটি থেকেই বুঝা যায়। স্পিন ও পেস উভয় ধরনের বোলিং আক্রমণই তিনি সমান পারদর্শীতায় ধ্বংস করে দিতে সক্ষম, আর তাই ম্যাচের ডেথ ওভারে ব্যাট হাতে ম্যাক্সওয়েলের উপস্থিতি বিপক্ষ দলের অধিনায়কের বেশ কিছু রাতের ঘুম হারাম করতে যথেষ্ট।
একারণেই ক্রিকেট জগতের সবচেয়ে দুর্দান্ত ফিনিশারদের তালিকায় তিনি অনায়াসেই স্থান করে নিয়েছেন, যদিও একদিনের ক্রিকেটে তার গড় ৩৫.৪ ও টেস্টে গড় ২৬.১ জানার পরে মনে হতেই পারে যে তিনি খুব বেশি হলে মধ্যম মানের একজন ব্যাটসম্যান। কিন্তু স্বকীয় খেলার ধরন এবং গড়পরতার বাইরে শট খেলে দলের বিজয় ছিনিয়ে আনতে তার মত সমর্থ ব্যাটসম্যান ক্রিকেট জগতে খুব কমই আছে।
ডেভিড মিলার (দক্ষিণ আফ্রিকা)
সদ্য সমাপ্ত হওয়া টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে সূর্যকুমারের অসাধারণ ক্যাচ ডেভিড মিলার আউট হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঐ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার জয় মোটামুটি নিশ্চিতই হয়ে পরে। এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করে রানের লক্ষ্য যত বড়ই হোক না কেন, মাঠে যতক্ষণ মিলারের ব্যাট চলবে, যে কোনো লক্ষ্যই অর্জন করা সম্ভব। আর এজন্যই তাকে যথার্থভাবেই ‘মিলার, দ্য কিলার‘ নামে ডাকা হয়। প্রায় দেড় দশকব্যাপী ক্যারিয়ারে তার অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্যের অসংখ্য নজির আন্তর্জাতিক ও লীগ উভয় ধরনের ক্রিকেট আসরেই বিদ্যমান।
টান টান উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজের সেরাটা দিয়ে দলের জন্য জয় ছিনিয়ে আনতে পটু এই ব্যাটসম্যানের একদিনের ম্যাচে স্ট্রাইক রেট ১০৩.৩ ও টেস্ট ক্রিকেট স্ট্রাইক রেট ১৪০.৫ অর্থাত্ তিনি প্রতি ১০০ বলে ১০০ এর উপরে রান সংগ্রহ করতে সক্ষম।
ল্যান্স ক্লুজনার (দক্ষিণ আফ্রিকা)
এই তালিকার পরবর্তী ফিনিশার একবিংশ শতকের শুরুর দিকে ক্রিকেট বিশ্বের প্রায় সকলের পছন্দের ব্যাটসম্যান ল্যান্স ক্লুজনার। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন এই ব্যাটসম্যান তার আক্রমণাত্মক ব্যাটিং এর মাধ্যমে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম একজন ফিনিশার হিসাবে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে। ব্যাটিং দক্ষতা ও পেশীশক্তি উভয়ের সমন্বয়ে ল্যান্স তার প্রায় প্রতিটি ইনিংসে নিয়মিতভাবেই বড় বড় চার-ছক্কা হাঁকিয়েছেন। আর একারণেই তার ক্যারিয়ারের সময়কালে তিনি অসংখ্য প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচের পরিণতি দক্ষিণ আফ্রিকার অনুকূলে ঘুরিয়ে এনেছেন।
কিরণ পোলার্ড (ওয়েস্ট ইণ্ডিজ)
ওয়েস্ট ইণ্ডিজের নির্ভরশীল, দক্ষ ও মারমুখে ব্যাটসম্যান কিরন পোলার্ড আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা একজন ফিনিশার। পেশীশক্তি ও দক্ষতার এক অনন্য সমন্বয় পোলার্ড অনায়াসেই চার-ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের হাত থেকে যথেষ্ট সংখ্যক বার বাঁচিয়েছেন। এছাড়া ম্যাচের উত্তেজনাপূর্ণ ও চাপের মুখে হিসেবি ঝুঁকি নিয়ে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর সামর্থ্য তাকে দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ওয়েস্ট ইণ্ডিজের প্রাক্তন এই অধিনায়ক বিশেষত সীমিত ওভারের খেলায় বেশি পারদর্শী। একদিনের ম্যাচে তার স্ট্রাইক রেট ৯৪.৪ এবং টিটোয়েন্টি ম্যাচে তার স্ট্রাইক রেট ১৩৫.১।
মাইকেল বেভান (অস্ট্রেলিয়া)
নব্বইয়ের দশকে অস্ট্রেলিয়া এমন এক অপ্রতিরোধ্য দল ছিল যাদের সামনে পর্বত প্রমাণ লক্ষ্যও পানির মতই সহজ মনে হতো। আর এর অন্যতম কারণ ছিল মাইকেল বেভান নামের একজন অনন্য সাধারণ ব্যাটসম্যান যাকে তার ক্যারিয়ারের সময়কালের সেরা ফিনিশার বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। এমনকি, অনেক ক্রিকেট বোদ্ধার মতে, বেভানের ব্যাটিং নৈপুণ্য ও দলকে অনায়াসে জেতানোর কৌশলই ক্রিকেট জগতে ‘ফিনিশার‘ শব্দটির প্রচলন শুরু করে! দলের প্রয়োজনে অতিমাত্রায় চাপের মুখেই যেন তার সেরা খেলাটা বেরিয়ে আসতো যার প্রমাণ মিলেছে ১৯৯৯ ও ২০০৩ সালের একদিনের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় অনায়াসে লব্ধ বিশ্বজয়ীর খেতাব প্রাপ্তিতে।
অস্ট্রেলিয়ার দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান ও অন্যতম সেরা ফিনিশার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল
মহেলা জয়াবর্ধনে (শ্রীলঙ্কা)
শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন অধিনায়ক যখন মাঠে ব্যাট হাতে খেলতেন তখন শুধু একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলাই যে চলতো তা-ই নয়, বরং ব্যাটিং নৈপুণ্যের অসাধারণ এক শৈল্পিক রূপও প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটতো। চাপের মুখে মাথা ঠাণ্ডা রাখার বিষয়টি যেন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য, আর মহেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রায় হেরে যাওয়া অনেক ম্যাচেেই মাথা ঠাণ্ডা রেখে, নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলে অসংখ্যবার তিনি দলকে জিতিয়েছেন।
ইওয়ান মর্গেন (ইংল্যাণ্ড)
ইংল্যাণ্ডের বিশ্বকাপ বিজয়ের কাণ্ডারী ও প্রাক্তন অধিনায়ক ইওয়ান মর্গেন আধুনিক ক্রিকেটের আরও একজন সেরা ফিনিশার। অনেকের মতে, তিনি শুধু যে ধোনির সমকক্ষ তা-ই নয়, বরং তার অধিনায়কত্বের কৌশলও ধোনির দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই অভিজ্ঞ ফিনিশার চাপের মুখে মাথা ঠাণ্ডা রেখে অনেকবারই দলকে ম্যাচ জিতিয়েছেন। এমনটা খুব কমই হয়েছে যে ইংল্যাণ্ডের হয়ে ইওয়ান লড়েছেন কিন্তু দল হেরে গিয়েছে। এমনকি দলের সকলের হতাশাজনক পার্ফর্ম্যান্সের কারণে পরাজয় মেনে নিতে হলেও ইওয়ান টিকে থেকেছেন ম্যাচের প্রায় শেষ পর্যন্ত।
শহীদ আফ্রিদি (পাকিস্তান)
নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধের দিকে অত্যন্ত সুদর্শন এক কিশোর পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দলে যোগ দিয়ে, একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে দ্রুততম সেঞ্চুরিটি হাঁকিয়ে রাতারাতি তারকা বনে যান এবং একই সাথে হয়ে ওঠেন লাখো ক্রিকেটপ্রেমীর প্রিয় ব্যাটসম্যান, যদিও বল হাতেও তার নৈপুণ্য ছিল অসাধারণ। চাপের মুখে ধৈর্য্য ধরে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে, হিসেবি ঝুঁকি নিয়ে দলকে জেতানোর প্রবণতা পাকিস্তানের বেশিরভাগ ক্রিকেটারের মধ্যেই অনুপস্থিত। এই কারণে মেধার কমতি না থাকলেও, পাকিস্তানের ঝুলিতে বাজেভাবে পরাজয়ের স্মৃতি অনেক বেশি।
যদিও ক্রিকেট দলীয় খেলা, কিন্তু যে দলে শহীদ আফ্রিদির মত একজন ব্যাটসম্যান জয়ের জন্য লড়তে থাকেন, তারাও অপ্রত্যাশিত জয়ের দেখা পায় বৈ কি! তবে তারও খেলায়ও ছিল নিয়ম-শৃঙ্খলার ও পেশাদারিত্বের অভাব। ক্রিকেট জগতে ‘বুম বুম‘ শব্দটি আফ্রিদির খেলার কারণেই প্রচলিত হয় কারণ ধীরেসুস্থে, মেপে খেলা তার ধাতে ছিল না। তাই অন্য অনেক খেলোয়াড়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিভাবান হলেও দলকে নিয়মিত জয়ের মুখ তিনিও দেখাতে পারেননি।
রবীন্দ্র জাদেজা (ভারত)
আধুনিক ভারতীয় দলের অসাধারণ একজন ব্যাটসম্যান ও অলরাউণ্ডার রবীন্দ্র জাদেজা সময়ের সাথে ভারতীয় জাতীয় দলের জন্য বেশ নির্ভরশীল একজন খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর তা হতেই হবে, কারণ তিনি যে সরাসরি ধোনি-র থেকেই দীক্ষা গ্রহণ করেছেন! তিনি যেভাবে তার প্রতিটি শট নির্বাচন করেন তা আধুনিক ক্রিকেটের খুব কম খেলোয়াড়ের মাঝেই দেখা যায়।
সেই সাথে রয়েছে তার সুদক্ষ ফিল্ডিং ও বোলিং যা দলকে জয় পাইয়ে দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর আইপিএল-এর মাঠে তার ব্যাটিং নৈপুণ্য শুধু যে দলকে জেতানোর কাজই করে তা নয়, বরং গ্যালারীতে উপস্থিত দর্শকদের বিনোদনের খোরাকও যোগায়। টেস্ট, ওডিআই, টিটোয়েন্টি ও আইপিএল-এ তার স্ট্রাইক রেট যথাক্রমে ৫৫.৮, ৮৫.১, ১২৭.২ ও ১২৯.৮।
মাইকেল হাসি (অস্ট্রেলিয়া)
মাইকেল বেভান অবসর গ্রহণের পরে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলে এই ফিনিশারের কমতি পূরণ হয়েছিল আরেক মাইকেলের দ্বারা- মাইকেল হাসি; বরং এটা বলাই শ্রেয় যে মাইকেল হাসির ব্যাটিং নৈপুণ্য মাইকেল বেভানের অভাব তেমন একটা বোধ করতেই দেয়নি। ক্রিকেট ম্যাচে চাপের মুখে ও উত্তেজনাকর মুহুর্তে মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজের সেরা খেলাটা দিয়ে দলকে জেতানোর দক্ষতা এবং ক্রিকেট সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান, ক্রিকেট জগতে মাইকেল হাসি-কে ‘মি. ক্রিকেট‘ খেতাব এনে দিয়েছে।
টগবগে উত্তেজনায় ভরপুর ম্যাচে তার অসাধারণ ব্যাটিং করার দক্ষতার কারণে আইপিএল-এ তার দল চেন্নাই সুপার কিংস-এ তাকে ওপেনিং এর দায়িত্বও দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার জন্য তিনি ১২,০০০ এরও বেশি রান সংগ্রহ করেছেন। তার অবসরের পরে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দল যে তার অভাব বেশ ভালভাবেই অনুভব করেছে তা বলাই বাহুল্য।
স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস (ওয়েস্ট ইণ্ডিজ)
ক্রিকেট জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাটসম্যানদের তালিকায় ওয়েস্ট ইণ্ডিজের প্রাক্তন ব্যাটসম্যান স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস বা ভিভ রিচার্ডস-এর নাম সবার আগে প্রায় সকলেরই মাথায় আসবে। তার মারকুটে ও বেপরোয়া খেলার মানসিকতা ও দক্ষতার কারণে অনেকেই তাকে ক্রিকেটের ‘গ্যাংস্টার‘ বলে মনে করে থাকে। প্রকৃতপক্ষেই তিনি ছিলেন ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ‘ফিনিশার‘, যদিও তার ক্যারিয়ারের সময়কালে এই শব্দটার প্রচলন শুরু হয়নি।
১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত তার উজ্জ্বল ক্যারিয়ারে তিনি ১৫,০০০ এরও বেশি রান সংগ্রহ করেছেন এবং সেই সময়ে বিপক্ষ দলের বোলারদের জন্য তিনি ছিলেন রীতিমত ত্রাস! একদিনের ক্রিকেটে তার স্ট্রাইক রেট ৯০। ব্যাটিং দক্ষতার জন্য তাকে ‘সুপারস্টার‘ নামে অভিহিত করা হয়। নি:সন্দেহে তিনি সর্বকালের সেরা ফিনিশারদের মধ্যে অন্যতম।
ক্রিকেটের কিংবদন্তী ও অন্যতম সেরা ফিনিশার স্যার ভিভ রিচার্ডস
জাভেদ মিয়াদাদ (পাকিস্তান)
ক্রিকেট বিশ্বের সর্বকালের সেরা ১৫ জন ফিনিশারের এই তালিকার সর্বশেষ ব্যাটসম্যান পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াদাদ- যদিও এই ক্রমিক অবস্থানের সাথে তার কৃতিত্ব বা প্রতিভার কোনো সম্পর্কই নেই। ১৯৭৫ সাল থেকে পাকিস্তানের জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে খেলার পরে ১৯৯৬ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে ১৬,০০০ রান। মোটামুটিভাবে ইনিংসের মাঝামাঝি সময়ে খেলতে নেমে জাভেদ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং এর মাধ্যমে শেষ বল পর্যন্ত বিপক্ষ দলের বোলারদের হতাশায় নিমজ্জিত করতেন বলেই তাকে সর্বকালের সেরা একজন ফিনিশার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রায় দেড় দশক ধরে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের ইতিহাসে অসংখ্য ব্যাটসমেন এখনো পর্যন্ত এসেছেন, অসাধারণ নৈপুণ্যে ব্যক্তিগত ও দলীয় কীর্তি রচনা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও এরকম অনেক ব্যাটসমেন আসবেন। কিন্তু সবাই ঠিক ফিনিশার হয়ে উঠতে পারবেন কি? কারণ, সব ফিনিশার ব্যাটসম্যান হলেও, সব ব্যাটসম্যান কিন্তু ফিনিশার হয় না!